মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন, সম্প্রচার আইনেও গণমাধ্যমের জন্য কড়া বার্তা
বিশেষ প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি,
ঢাকা (১৫ অক্টোবর ২০১৮) : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশে–বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যেই সরকার সম্প্রচারমাধ্যমগুলোর জন্য নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে নতুন একটি আইন চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে।
১৫ অক্টোবর সোমবার মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া সম্প্রচার আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, সম্প্রচার ও অনলাইন মাধ্যমে কোনো আলোচনা (টক শো) অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য–উপাত্ত প্রচার করা যাবে না। যেকোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত, গোপনীয় ও মর্যাদাহানিকর তথ্য এবং জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রচার নিষিদ্ধ করে বলা হয়েছে, কেউ তা করলে অপরাধ হিসেবে শাস্তি পেতে হবে।
চার বছর আগে ২০১৪ সালে জারি করা জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় এ ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার পর গণমাধ্যম–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এত দিন পর এসে সম্প্রচার আইনের খসড়াতেও ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে ওই নীতিমালার বিধিনিষেধগুলো রাখা হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে সরকার সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এসব দেখভাল করার জন্য সাত সদস্যের কমিশন কাজ করবে। ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে কমিশনের হাতে। এই কমিশন সম্প্রচার লাইসেন্স ও অনলাইন গণমাধ্যমের নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
গতকাল সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সম্প্রচার আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। একই বৈঠকে গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনের খসড়াও নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই আইনে সাংবাদিকদের ‘শ্রমিক’–এর পরিবর্তে ‘গণমাধ্যমকর্মী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
গণমাধ্যম–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোর স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় এর অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা আছে। সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) এই দুটি আইনের খসড়া সম্পর্কে সরকারকে বেশ কিছু সুপারিশ ও আপত্তি জানিয়েছিল। সেগুলোর বেশির ভাগই উপেক্ষা করা হয়েছে।
সংবাদ ও বিজ্ঞাপন প্রচারে বিধিনিষেধ
সম্প্রচার ও অনলাইন মাধ্যমে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। আলোচনা অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত প্রচার করা যাবে না। দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভাবধারার পরিপন্থী অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন সামরিক, বেসামরিক ও সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না। এ ছাড়া বিজ্ঞাপনে শিশুদের পরনিন্দা, বিবাদ ও কলহের দৃশ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের দৃশ্য দেখানো যাবে না। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে পারে এমন অনুষ্ঠান বা বক্তব্যও প্রচার করা যাবে না। এসব বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড পেতে হবে।
সম্প্রচার আইনে খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো লাইসেন্স বা নিবন্ধন সরকারের অনুমোদন বা সম্মতি ছাড়া হস্তান্তর করা হলে তা বাতিল বা অকার্যকর হয়ে যাবে। কোনোভাবেই ৪০ শতাংশের বেশি লাইসেন্স হস্তান্তর করা যাবে না। সাজা পেয়েছেন এমন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, ঋণখেলাপি, একবার লাইসেন্স বা নিবন্ধন বাতিল হয়েছে এমন ব্যক্তিরা লাইসেন্স পেতে আবেদন করতে পারবেন না। ভোক্তারা তাদের অসুবিধার বিষয়ে সম্প্রচার বা অনলাইন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ বা নালিশ করতে পারবে। এ জন্য যথেষ্টসংখ্যক কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, নাশকতা ও সহিংসতা উৎসাহিত করে অথবা জনশৃঙ্খলা বিনষ্টের আশঙ্কা সৃষ্টি করে, অশ্লীল বা বিদ্বেষমূলক কোনো তথ্য প্রচার করা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে এবং সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে।
খসড়া অনুযায়ী, সাত সদস্যের কমিশন সম্প্রচারকারী ও অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি সহায়ক নির্দেশিকা প্রস্তুত করবে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা এবং জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা লঙ্ঘন করে কোনো সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালালে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কমিশন শাস্তি আরোপ, মামলা এবং প্রয়োজনে আরও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।
সম্প্রচার কার্যক্রম বলতে দেশ ও বিদেশ থেকে স্যাটেলাইট অথবা টেরিস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে অথবা কেব্লের মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচারিত সব ধরনের টেলিভিশন, বেতার ও অন্যান্য বিষয়বস্তু প্রচারকে বোঝাবে। ইন্টারনেটভিত্তিক রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র বা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত স্থির ও চলমান চিত্র, ধ্বনি ও লেখ বা মাল্টিমিডিয়ার অন্য কোনো রূপে উপস্থাপিত তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ বা সম্প্রচার কার্যক্রম হিসেবে গণ্য হবে। অনলাইন গণমাধ্যমও এর আওতায় পড়বে।