সুবহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের ৯ অভিযোগ
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ যুদ্ধাপরাধের নয়টি অভিযোগ এনে প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছে।
প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হান্নান খান শনিবার বলেছেন, রোববার প্রসিকিউশনের কাছে তা হস্তান্তর করবেন তারা।
পাবনা সদরের সাবেক সংসদ সদস্য সুবহানকে গ্রেপ্তারের এক বছর পর তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করল তদন্ত সংস্থা।
প্রসিকিউশন বিভাগ এই প্রতিবেদন ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপনের মাধ্যমে এই জামায়াত নেতার বিচার প্রক্রিয়া শুরুর উদ্যোগ নেবে।
ধানমণ্ডিতে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে হান্নান খান সাংবাদিকদের বলেন, সুবহানের বিরুদ্ধে আট ধরনের অপরাধের মোট নয়টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্র।
গত বছরের ১৫ এপ্রিল এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর পর মোট ৪৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
রোববার প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর কাছে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হবে বলে জানান তদন্ত সংস্থার সমন্বয়কারী।
১৯৩৬ সালে পাবনার সুজানগর থানার মানিকহাটি ইউনিয়নের তৈলকুণ্ডি গ্রামে জন্ম নেন সুবহান। পাকিস্তান আমলে পাবনা জেলা জামায়াতের আমির ও কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর তিনি পাবনা জেলা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি এবং পরে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন। তার নেতৃত্বে পাবনা জেলার বিভিন্ন থানায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়।
২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পাবনায় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করেন সুবহান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নামের তালিকা করে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে সরবরাহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ইয়াহিয়া সরকারের পতন দেখে গোলাম আযমের সঙ্গে তিনিও পাকিস্তানে পালিয়ে যান।
তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সদস্য সানাউল হক বলেন, মওলানা সুবহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাবনা জেলার বিভিন্ন থানায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের নিয়ে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন।
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে-
> ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সহযোগী জামায়াত নেতা ও বিহারীদের নিয়ে পাবনার ঈশ্বরদীর জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়া স্বাধীনতাকামী মানুষদের অপহরণ করে হত্যা করা।
> ১৩ এপ্রিল তার নেতৃত্বে ও উপস্থিতিতে ঈশ্বরদীর যুক্তিতলা গ্রামে লুটপাট ও ব্যাপক ক্ষতি করে পাঁচজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে এবং তিনজনকে গুরুতরভাবে আহত করা হয়।
> ১৬ মে ঈশ্বরদী অরণখোলা গরুর হাট থেকে দুজনকে অপহরণ করে জেলা পরিষদ ডাক বাংলোতে (ঈশ্বরদী, পাবনা) নিয়ে নির্যাতন করা।
> ২ মে তার নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদীর সাহাপুর গ্রামে অসংখ্য বাড়িঘরে লুটপাট করে বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং কয়েকজনকে হত্যা করে।
> ১১ মে তার নেতৃত্বে ও উপস্থিতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পাবনা সদর থানার কুলনিয়া ও দোগাছি গ্রামে অভিযান চালিয়ে সাতজন নিরস্ত্র ও স্বাধীনতাকামী মানুষকে হত্যা এবং কয়েকটি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া।
> ১২ মে তার নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক বিরাট বহর সুজানগরের কয়েকটি গ্রামে অভিযান চালিয়ে তিন-চারশ’ মানুষকে হত্যা করে বিভিন্ন বাড়িঘরে লুটপাট চালায় ও পুড়িয়ে দেয়া।
> ২০ মে তার নেতৃত্বে পাবনা সদর থানার ভাড়ারা গ্রামে ১৮ জনকে অপহরণ করে হত্যা। এদের মধ্যে একজনকে ওই গ্রামের একটি স্কুলে হত্যা করা হয়। বাকি ১৭ জনকে সদর থানার নূরপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতনের পরে আটঘরিয়া থানার দেবত্তোর বাজারের পাশে বাঁশবাগানে গুলি করে হত্যা করা।
> সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে আতাইকুলা থানার (সাবেক পাবনা সদর থানা) দুবলিয়া বাজার থেকে দুজন স্বাধীনতাকামীকে অপহরণ করে কুচিয়ামাড়া গ্রামে একটি মন্দিরের ভেতরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা।
> ৩০ অক্টোবর রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ঈশ্বরদীর বেতবাড়িয়া গ্রামে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া এবং চারজনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা।
২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজা থেকে সুবহানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর তিন দিন পর প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে তদন্তের স্বার্থে তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন জানায়।
প্রসিকিউশনের আবেদন আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল ৩০ সেপ্টেম্বর এই জামায়াত নেতাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে কারাগারে বিশেষ মর্যাদা পাচ্ছেন তিনি।
সুবহানের আগে সম্প্রতি জামায়াতের দুই নেতা মীর কাসেম আলী, এ কে এম ইউসুফের বিচার শুরু হয়েছে। অভিযোগ গঠনের শুনানি চলছে এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
এর আগে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে ট্রাইব্যুনালে পাঁচ জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। তারা হলেন- আব্দুল কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, গোলাম আযম, মো. কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মো. মুজাহিদ।
এর মধ্যে গোলাম আযম ও কাদের মোল্লা ছাড়া অন্য সবার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। গোলাম আযমের ৯০ বছর এবং কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
এছাড়া জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিচার শেষের পথে রয়েছে।