ভুয়া কাগজপত্রে ক্ষুদ্র ঋণ! সানবীমের বিরুদ্ধে অর্থলোপাটের অভিযোগ

বিশেষ প্রতিবেদক, এবিসিসিউজবিডি, ঢাকা (১০ অক্টোবর ২০২০) : দেশের আর্থিক সামাজিক কর্মকান্ডে অবদান রাখা পূবালী ব্যাংক হারাতে বসেছে তার পুরনো ঐতিহ্য ও সুনাম। বাঙালির অহংকার ও আস্থার এই ব্যাংকটির ক্ষুদ্র ঋণ-দানে নিয়োগ দেয়া একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, গ্রাহক হয়রানি ও ঘুষ গ্রহনসহ সনদ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে মখ থুবড়ে পড়তে পারে পূবালী ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণ-দান কার্যক্রম। শুধু তাই নয়, ভুয়া কাগজ-পত্রে দেয়া ঋণের টাকা ফেরত না আনা গেলে বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে ব্যাংক। গ্রাহকরা এ বিষয়ে দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অপরদিকে অনিয়ম আর জালিয়াতি লোক দেখানো শাস্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তাকে সম্প্রতি চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

জানা গেছে, পূবালী ব্যাংক কিছু ক্ষুদ্র ঋণ (গাড়ি, ফ্ল্যাট, পার্সোনাল) প্রদানে তাদের এজেন্ট হিসেবে সানবীম এন্ড সানবীম কমার্শিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডকে ’৯৮ সালের দিকে নিয়োগ প্রদান করে। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্ব পাওয়ার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন পদে পদে উপেক্ষা করে শত শত কোটি টাকা ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েছে সানবীম। আলোচিত এই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের দায়িত্ব পাওয়ার পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দালাল চক্রের মাধ্যমে গ্রাহক সংগ্রহ করে। এই দালাল চাক্রের খপ্পড়ে পড়ে অসংখ্য গ্রাহক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মোটা অংকের ঘুষ দিতেও তারা বাধ্য হচ্ছেন।

সানবীমের এই দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে, ঋণ গ্রাহকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকলেও তাদের কাছে থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ করে জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ক্ষেত্রে জমা দেয়া ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ব্যবসায়িক লাইসেন্স, আয়কর সনদ, জমি-জমার ভুয়া কাগজপত্র। কখনও কখনও গ্রাহকের নামও পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলা হয় ঋণ প্রদানে।

এসব অনিয়মে উঠে আসে রাজধানীর বাসাবোর পূবালী ব্যাংক শাখায় সিএলএস কর্মকান্ডে নিয়োজিত সানবীম অ্যান্ড সানবীম কর্মাশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলামের নাম। অনুসন্ধানে জানা যায়, জাহিদুল ইসলাম সিআইবি ইনকোয়ারি দেয়ার সময় ঋণ গ্রহীতা এবং জন্ম তারিখ টেম্পারিং করে নকল এনআইডি’র ভেরিফিকেশন কপি সরবরাহ করতো। তার এই সুকৌশল কারসাজির কারণে ঋণ আবেদনের সময় ঋণ খেলাপি ঋণ গ্রহীতা এবং গ্যারান্টরের সিআইবি রিপোর্ট নিল দেখাতো। অত্যন্ত চতুর জাহিদুল ইসলাম বিভিন্ন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে টেম্পারিং করে তৈরি করতো ভুয়া কাগজ-পত্র।

এসব বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, পূবালী ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয় এবং শাখার অনুরোধক্রমে প্রধান কার্যালয় তদন্ত করলে জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর সানবীম এন্ড সানবীম কমার্শিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড সম্প্রতি তাকে চাকুরীচ্যুত করে। পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাহিদুল ইসলামকে সিএলএস ঋণ বিতরণের সমস্ত কার্যক্রমে নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং তাকে যে কোনো এজেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যাংকে প্রবেশে নিষেধজ্ঞা দিয়ে আদেশ জারি করেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এজেন্ট মালিক গণমাধ্যমকে বলেন, জালিয়াতি দিয়েই সানবীমের জন্ম। সানবীম এন্ড সানবীম কমার্শিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের মাধ্যমে যে সব ঋণ প্রদান করা হয়েছে, পূবালী ব্যাংক তার সুষ্ঠু তদন্ত করলে এমন শত শত জালিয়াতি ঘটনা উন্মোচিত হবে। ভুয়া গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের নামে-বেনামে অসংখ্য ঋণ নিয়ে টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে সানবীমের যাত্রা। এসব গ্রাহকের নাম, ঠিকানা, আইডি কার্ড কোনো কিছুই সঠিক নয়।

এছাড়া সানবীম অবৈধ অর্থের প্রভাবে ব্যাংকের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে কব্জায় এনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইতিমধ্যে শত কোটি টাকারও বেশি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করেছে। অভিযোগকারীরা জানান, সানবীমের অসংখ্য গ্রাহক বর্তমানে ট্রেসলেস (ঠিকানা নেই)। অথচ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে আজও তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি, যা রহস্যজনক। ব্যাংকের গ্রাহকরা এ বিষয়ে দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তারা মনে করেন, দুদকের পক্ষ থেকে জরুরী ভিত্তিতে কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়া হলে পূবালী ব্যাংক বড় ধরণের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে।

‘ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ৯% এর বেশি লভ্যাংশ নিতে পারবে না’ বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন নির্দেশনা (সার্কুলার) থাকলেও সানবীম ঋণ প্রদানের শর্ত হিসেবে ৯% এর সাথে আরো ৩% কমিশন হিসেবে নগদ প্রদানে বাধ্য করছে গ্রাহকদের। সানবীমের একাধিক কর্মকর্তার মুখেও এমন অভিযোগ শোনা গেছে। এছাড়া গাড়ি ঋণের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের দু-একটি কিস্তি বকেয়া পড়লে কোনো রকম নোটিশ ছাড়াই গাড়ি জব্দ করে মোটা অংকের চাঁদা দিতে বাধ্য করার অভিযোগ করেছেন একাধিক গ্রাহক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূবালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সানবীমের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভালো সম্পর্ক থাকায় তারা সানবীমের অনেক অন্যায্য দাবি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চইলে সানবীম এন্ড সানবীম কমার্শিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান তসলিমা আক্তার এবিসিনিউজবিডিকে বলেন, ‘যেসব অভিযোগ সানবীমের বিরুদ্ধে উঠেছে তা সব মিথ্যা ও বানোয়াট।’ চেয়ারম্যান এ বিষয়ে সামনা-সামনি কথা বলবেন জানিয়ে তার অফিসে আমন্ত্রণ জানান। প্রতিবেদক এতে অপারগতা প্রকাশ করে সানবীমের কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের অপসারণের কারণ জানতে চাইলে তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘জলিয়াতি করার আগে তা ধরা পড়ায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।’ অভিযোগ রয়েছে, ভুয়া কাগজপত্র তৈরী করে সানবীম পূবালী ব্যাংক থেকে ঋণ পাইয়ে দিয়েছে অনেককে। এসব ঋণ যারা নিয়েছেন, তাদের এখন কোন ঠিকানাও পাওয়া যাচ্ছে না। এসব ঋণ গ্রহিতার কাছ থেকে পূবালী ব্যাংকের এই অর্থ আপনার সানবীম কি ফেরত আনতে পারবে? এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চেয়ারম্যান তার অফিসে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আমন্ত্রণ জানান।

তবে সানবীমের জালিয়াতির বিষয়ে সিএলএস প্রধান দেওয়ান জামিল মাসুদ বলেন, ব্যাংকের বাসাবো শাখায় কয়েকটি জালিয়াতির প্রমাণ তারা পেয়েছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। ঋণ দিতে ৩ পার্সেন্ট ঘুষ নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযোগ পেলে সব অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সানবীমের অপকর্মের দায় পূবালী ব্যাংক এড়াতে পারেন না বলেও মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ