মিরপুর মডেল থানা পুলিশের সাফল্য, ২৪ ঘন্টায় ক্লু-লেস মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, খুনিদের পাকরাও
মেহ্দী আজাদ মাসুম : জুয়েল রানা। বয়স আনুমানিক ২৯ বছর। মালবোরো টোবাকো কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। প্রায় সময়ই তার সঙ্গে থাকতো টোবাকো কোম্পানির নগদ টাকা। পূর্ব-পরিচিত মিরাজের চোখ পড়ে এই টাকার প্রতি। দুই সহযোগীকে নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করে সে। দু’দিন আগে অর্থাৎ ১৭ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক ১০টার দিকে রশি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয় রাজধানীর গাবতলী এলাকায়। এরপর জুয়েল রানার মরদেহ ড্রামে ভরে ফেলে রেখে যায় মিরপুর মডেল থানা এলাকার লাভ রোডে। সংবাদ পেয়ে রাত দুটার দিকে মিরপুর থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার কওে মর্গে পাঠায়। রহস্য উদঘাটে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহতাব উদ্দিনের নির্দেশে মিরপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মুস্তাজিরুর রহমানের নেতৃত্বে তৎপর হয়ে ওঠেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই (নিরস্ত্র) মো. খোকন মিয়া। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ঘটনার ২৪ ঘন্টা না পেরুতেই ক্লু-লেস এই মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করে মিরপুর থানা পুলিশ।
বিষয়টি নিয়ে মিরপুর ডিসির কার্যালয়ে আজ রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ডিসি ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে এডিসি মাহবুবুর রহমান এবং মিরপুর মডেল থানার ওসি মুস্তাজিরুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নিহত জুয়েল রানা টোবাকো কোম্পানি মালবোরোর বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। সব সময় তার কাছে টোবাকোর বিক্রয়ের মোটা অঙ্কের টাকা থাকতো। জুয়েল রানার পূর্বপরিচিতি একটি দুধ বিপননকারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি মো. মিরাজের হঠাৎ টাকার বিশেষ প্রয়োজন হয়। সে জানতো জুয়েলের কাছে নগদ টাকা আছে। সেই টাকা হাতিয়ে নিতেই মিরাজ দুই সহযোগীকে নিয়ে জুয়েলকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো জানানো হয়, পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সে মো. রাসেল (১৯) ও আরেকজনকে (অপ্রাপ্ত বয়স্ক বয়স ১৫) সঙ্গে নেয়। তারা প্রথমে গাবতলীতে একটি কাভার্ডভ্যানে উঠে তিন দফায় ইয়াবা সেবন করে। এরপর রাত ১০টার দিকে জুয়েলকে ডেকে কাভার্ডভ্যানে উঠিয়ে ইয়াবা সেবন করায়। এক পর্যায়ে মুখ চেপে ও রশি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে জুয়েলকে শ্বাসরোধে হত্যা নিশ্চিত করে। এরপর তারা সেই মালবোরোর কাভার্ডভ্যানেই আগে থেকে কেনা ড্রামে জুয়েলের লাশ ভরে গাবতলী থেকে মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকে। এই সময়ে দুধের ডেলিভারিও মিরাজ। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে মিরপুর রাভ রোডের পাশে রাস্তায় জুয়েলের লাশভর্তি ড্রাম ফেলে পালিয়ে যায়।
ডিসি জানান, স্থানীয়দের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাত আনুমানিক ২টার দিকে ঘটনাস্থলে যায় মিরপুর থানা পুলিশ। উপস্থিত হয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের পর সুরতহাল শেষে ময়না তদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে পুলিশ। পরে নিহতে গায়ে থাকা ‘সাফল্যের পথে একসাথে’ লেখা গেঞ্জির সূত্র ধরে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত ও খুনীদের সনাক্ত করে পুলিশ। তদন্ত জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জড়িত তিন যুবককে গ্রেফতার করে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ।
সংবাদ সম্মেলনে মাহতাব উদ্দিন বলেন, লাশ উদ্ধারের পর আমরা নিহতের ফ্রিঙ্গার প্রিন্ট ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও নিহতের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তবে নিহতের গায়ে থাকা গেঞ্জিতে ‘সাফল্যের পথে একসাথে’ লেখা দেখে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, ওই শ্লোগান সম্বলিত গেঞ্জিটি একটি টোবাকো কোম্পানির। মালবোরো নামক ওই সিগারেট কোম্পানির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও নিহতের ছবি দেখিয়ে জানা যায়, নিহতের নাম মো. জুয়েল রানা(২৯)। তার বাড়ি ভোলা সদরে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবি দেখালে তারাও পরিচয় নিশ্চিত করেন।
নিহতের স্ত্রী মোসা. সালমা আক্তার পুলিশের খবরে ঢাকা আসেন। পরদিন তিনি মিরপুর মডেল থানায় বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
তিনি আরো বলেন, মামলাটি তদন্ত করছিল মিরপুর মডেল থানার এসআই (নিরস্ত্র) মো. খোকন মিয়া। তদন্তভার গ্রহণ করে তিনি ঘটনাস্থলের আশেপাশে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেন, জড়িতদের নাম পরিচয় সনাক্ত ও গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করেন। এরই এক পর্যায়ে শনিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে দারুস সালাম থানাধীন গৈদারটেক এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ঘটনায় জড়িত ও তদন্তে সনাক্ত মো. মিরাজ (১৮)কে গ্রেফতার করা হয়।
ডিসি বলেন, গ্রেফতার মিরাজ রাজবাড়ীর কালুখালীর মো. রওশন মন্ডলের ছেলে। অভিযানকালে তার কাছ থেকে নিহত জুয়েল রানার হেফাজত হতে নেয়া মালবোরো কোম্পানির সিগারেট বিক্রয়লব্ধ নগদ ৩৮ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
তিনি জানান, পরে জিজ্ঞাসাবাদে মেরাজের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে মিরপুর সেকশন-২ এর এফ ব্লকের ১ নং রোডের ১৪ নং বাসা হতে হত্যায় ব্যবহৃত সিলভার রংয়ের কাভার্ড ভ্যান (রেজিঃ নং ঢাকা মেট্রো ম-৫১-৪৭৯৫) জুয়েল রানার ছবি সম্বলিত মালবোরো সিগারেট কোম্পানীর আইডি কার্ড, চার কার্টুন মালবোরো সিগারেট জব্দ করা হয়। পরে পল্লবী থানাধীন সেকশন-১১ কাচা বাজার এলাকা হতে হত্যার ঘটনায় জড়িত অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুনকে (১৫) গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে মালবোরো কোম্পানির সিগারেট বিক্রয়লব্ধ নগদ ৭ হাজার টাকা ও ভিভো এন্ড্রোয়েড মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। তাদের দুজনের দেয়া তথ্যমতে একই এলাকা থেকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মো. রাসেল (২০)কে গ্রেফতার করা হয় সে বরিশাল হিজলার কায়েসমা (রাঢ়ী বাড়ী) এলাকার আব্দুল সত্তারের ছেলে।
জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে মিরপুর বিভাগ পুলিশের উপ-কমিশনার মাহতাব উদ্দিন বলেন, টাকার বিশেষ প্রয়োজন ছিল মিরাজের। সে টাকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে রাসেলকে জানায়। মূলত: রাসেলের পরামর্শ ও পরিকল্পনায় জুয়েল মিয়াকে হত্যার ছক কষে তারা। শুধু টাকার জন্যেই জুয়েল হত্যার শিকার নাকি মাদক কেন্দ্রিক তাদের দ্বন্দ্ব ছিল জানতে চাইলে ডিসি মাহতাব বলেন, মার্লবোরো সিগারেট কোম্পনিতে বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করায় জুয়েলের কাছে বিক্রয় বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা মজুদ থাকে এটা জানতে মিরাজ। মূলত: তিনজন মিলে ওই টাকাটা হাতিয়ে নিতেই হত্যার পরিকল্পনা করে।
তিনি বলেন, রাসেলের পরিকল্পনা মোতাবেক তারা প্রথমে ড্রাম কেনে। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে গাবতলীতে জুয়েলকে আসতে বলে। জুয়েল ঘটনাস্থলে আসলে তিনজন মিলে ইয়াবা সেবন করে। তিন দফা ইয়াবা সেবনের একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় রাসেলও। তিনজন মিলে কাভার্ড ভ্যানের ভেতরে বসে পিছন হইতে রশি দিয়ে জুয়েল রানাকে গলায়সহ নাকমুখ পেচিয়ে ফেলে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মেরাজ পা-মুখ চেপে ও শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে নিহত জুয়েলের কাছে থাকা মালবোরো কোম্পানির মালামাল বিক্রয়লব্ধ ৭৬ হাজার টাকা ভাগ করে নেয়।