সয়াবিন তেলে ক্ষোভ অসন্তোষ
বিশেষ প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকা (৭ মে ২০২২) : সয়াবিন তেল নিয়ে তেলেসমতি চলছেই! দুই বছর আগের ১০৫ টাকার এই ভোজ্য তেল এক বছরের মাথায় (গত বছর) ১৩৪ টাকা, গত ফেব্রুয়ারিতে ১৬৮ টাকা এবং সর্বশেষ বৃহস্পতিবার এক লাফে ১৯৮ টাকা! সয়াবিন তেলের এমন মূল্য নির্ধারণ এবং ভয়াবহ সংকটে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। তেলের এই উর্ধ্বগতিতে রাজধানীসহ সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লেও নিষ্ক্রিয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ব্যবসায়ী হিসেবে মন্ত্রীও থাকছেন ব্যবসায়ীদের পক্ষে। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা তেলেসমতির অন্তরালে থাকা কুশিলবদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। তারা মনে করছেন, সরকারকে বিপাকে ফেলতেই ভোজ্য পণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।
সয়াবিন তেল নিয়ে সারা দেশে তীব্র সংকট সৃষ্টির মাঝেই বৃহস্পতিবার (৫ মে) সরকারের পক্ষ থেকে কেজি প্রতি ১৯৮ টাকা ধার্য্য করা হয়। যদিও গতকাল শুক্রবার উর্ধ্বগতির নতুন মূল্যেও বাজারে দেখা মেলেনি সয়াবিন তেলের। অথচ ক’দিন আগেও রাজধানীর বড় বড় বাজার ও ডিপার্টন্টোল স্টোরগুলোতে সয়াবিন তেলের মজুদ ছিলো ব্যাপক। রমজানের শুরু থেকেই সংকট সৃষ্টি হয় এই ভোজ্য তেলের।
সয়াবিন তেল আমদানীকারক সূত্র থেকে জানা গেছে, তীব্র সংকট সৃষ্টি হওয়া বোতলজাত সয়াবিন তেল সারাদেশে দুই বছর আগে লিটার প্রতি ১০৫ টাকা দরে বিক্রয় হয়েছে। গত বছর ১৩৪ টাকা এবং চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয় ১৬৮ টাকা। ব্যবসায়ীরা মার্চ থেকে লিটারে আরও ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৮০ টাকা করতে সরকারকে তাগিদ দেন। কিন্তু সরকার এতে রাজি না হয়ে ভোজ্যতেল উৎপাদন ও বিক্রির ওপর থেকে ভ্যাট পুরোপুরি আর আমদানিতে ৫ শতাংশ রেখে বাকি সব ভ্যাট প্রত্যাহার কওে নেয়। পরে গত ২০ মার্চ লিটারে ৮ টাকা কমিয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ঠিক করা হয় ১৬০ টাকা। এরই এক মাস না পেরোতে গত বৃহস্পতিবার এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এখন থেকে রান্নায় ব্যবহৃত এই সয়াবিন তেল লিটার প্রতি কিনতে হবে ২০০ টাকা ছুঁইছুঁই দামে। তাও ব্যবসায়ীদের সুবাদে যদি বাজারে পাওয়া যায়, তবেই।
সয়াবিন তেলের এই উর্ধ্বগতিতে রাজধানীসহ সারা দেশে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লেও প্রায় নিষ্ক্রিয়ই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী টিপু মুনশী নিজেও একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেও থাকছেন ব্যবসায়ীদের পক্ষে। মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রায়শই তাকে বলতে শোনা যায়….. ‘আমি আগে টেবিলের সামনে বসতাম। এখন মন্ত্রী হয়ে টেবিলের ভেতরে বসি। তফাৎ শুধু এই টুকুই।’
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা মনে করেন, সয়াবিন তেল নিয়ে তেলেসমতির অন্তরালে আছে ব্যবসায়ী নামধারী কিছু ষড়যন্ত্রকারী। এরাই তেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির কুশিলব। হাতে গোনা ৫-৬টি বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকরা পর্দার আড়াল থেকে সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। তারা মনে করছেন, সরকারকে বিপাকে ফেলতেই তেল নিয়ে কারসাজি চলছে।
সয়াবিন তেলের এমন মূল্য নির্ধারণ এবং ভয়াবহ সংকটে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রাজধানীর কাওরান বাজারে খিলগাঁও থেকে সয়াবিন তেল ক্রয় করতে আসা পরিবহন ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তালতলা বাজারসহ বাসাবো-খিলগাঁও এলাকায় কোন দোকানে সয়াবিন তেল না পেয়ে কাওরান বাজারে এসেছি। এখানেও সয়াবিন তেল পেলাম না।’
বিষয়টিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তরিকুল ইসলাম বলেন, এর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কোনভাবেই দোষ দেয়া যাবে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী এমন সব বিষয় দেখভাল করতেই তো বিশাল মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। তারা কি করছেন। কি করছেন বাণিজ্য মন্ত্রী। তিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী, স্বার্থ দেখছেন ব্যবসায়ীদের।’ যদি এমন হয়, তবে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখবে কে? প্রশ্ন করেন তরিকুল।
মগবাজার থেকে কাওরান বাজারে আসা স্কুল শিক্ষক হামিদুল ইসলাম সয়াবিন তেলে মূল্য বৃদ্ধি ও সংকটকে কৃত্রিম হিসেবে অভিহিত করে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা কখনোই কোন সরকারের হয় না। হয় না সাধারণ মানুষেরও। তারা নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থাকেন। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণ ব্যার্থ। ব্যবসায়ীদের এখনই নিয়ন্ত্রণ দরকার।’ সরকারের নীতি নির্ধারকদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান এই শিক্ষক।
সয়াবিন তেলের সংকটের বিষয়ে ভোজ্যতেলের অন্যতম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা গতকাল বলেন, ‘আপনি ব্যবসা করলে কি লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন? কোম্পানিগুলোর কী দায় পড়েছে লিটারে ৫০ টাকা লোকসান দিয়ে তেল সরবরাহের।’ বাজারে তেলের সরবরাহে ঘাটতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার দাম সমন্বয় করেছে। এখন পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারওয়ান বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এখন যাদের কাছে তেল মজুত আছে, তারা সয়াবিন তেলের বোতলের মুখ খুলে সে তেল খোলা আকারে বিক্রি করছেন। এতে তাদের লাভ বেশি হচ্ছে, ঝুঁকিও কম।’
ব্যবসায়ীরা বলেন, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়েছে। সঙ্গত কারণে আমাদের বাজারেও তার প্রভাব পড়বে এমন ভাবনায় ডিলার ও খুচরা দোকানিরা তেল বিক্রি না করে মজুত করছেন। পওে বেশি দামে বিক্রি করবেন, এ কারণেই তারা তেলের সরবরাহের সংকট বলে অজুহাত দেখাচ্ছেন। বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট বিষয়ে ব্যবসায়ীরা আরো বলেন, ‘মিল মালিকরা তেলের সরবরাহ ঠিক রাখলেও ডিলার, পাইকার ও খুচরা দোকানিরা চাহিদা অনুযায়ী তেল বিক্রি করছেন না।
গতকাল কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট ও হাতিরপুল বাজার ঘুরে কোথাও সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। হাতিরপুল বাজারে রোকসানা নামের একজন গৃহিণী বোতলজাত সয়াবিন তেল নিতে এসে হাফ লিটারেরর একটি বোতল পেয়েছেন বলে জানান। তবে এই হাফ লিটার বোতল নিতে তাতে গুনতে হয়েছে ৭০ টাকা।
গ্রিন রোডের স্বপ্ন সুপার শপে গিয়ে দেখা গেছে, বোতলজাত কোনো সয়াবিন তেল তাদের ডিসপ্লেতে নেই। দায়িত্বরত কর্মী জানান, ঈদের আগেই তেল শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সেখানে কেনাকাটা করতে আসা মনির হোসেন মিন্টু বলেন, ‘অনেক দোকান ঘুরলাম। কারো কাছে তেল নেই। ভাবলাম এখানে পাবো, অথচ এখানেও নেই।’
বাংলাদেশ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক থাকলে তেলের এ সংকট দেখা দিত না। প্রতিটি মার্কেটে পরিবেশক রয়েছে, তারা রমজানের সময় চাহিদা অনুযায়ী তেল পাননি। মিল মালিকরা অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেরা ভালো থাকতে চাচ্ছে।’
তেলের মূল্য বৃদ্ধি, বাজারে তেলের সংকটসহ সার্বিক বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘বাজারে সয়াবিন তেল সংকট নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, মিলগুলো তাদের সরবরাহ ঠিক রাখলেও ডিলার, পাইকার ও খুচরা দোকানিরা চাহিদা অনুযায়ী দোকান থেকে তেল বিক্রি করছেন না। তারা পর্যাপ্ত তেল মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন। আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযানে গিয়ে তার প্রমাণ পেয়েছি। এ কারণে আমরা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে তেল মজুত করার দায়ে জরিমানাও করেছি।’