ছাত্রত্ব শেষ, তবুও সভাপতি রেজাউল
মনির হোসেন মিন্টু, বিশেষ প্রতিবেদক, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকা (২২ মার্চ ২০২৩) : পা-টিপিয়ে আলোচনায় আসা ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল হকের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে ১০ বছর আগে। বিষয়টি জেনেও তার হতে তুলে দেয়া হয়েছিলো চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির পদ। কয়েকজন ছাত্রনেতাকে দিয়ে পা-টেপানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে আলোচনায় আসে সভাপতির ছাত্রত্বের বিষয়টি। তবে এ নিয়ে অজ্ঞাত কারণে চুপ-চাপ ছাত্রলীগের কেন্দ্র! তবে বিষয়টি নিয়ে আজ সচিবালয়ে কথা বলতে পারেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
জানা গেছে, প্রায় ১৭ বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পা-টিপিয়ে আলোচনায় আসা রেজাউল হক। প্রায় ১০ বছর আগে তার ছাত্রত্ব শেষ হয়। কিন্তু তিনি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির পদ বাগিয়ে আছেন দায়িত্বে।
গত সোমবার রেজাউলের একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তিনি নতুন করে আলোচনায় আসেন। ছবিতে দেখা যায়, রেজাউল হলের কক্ষের বিছানায় শুয়ে মুঠোফোনে ফেসবুক চালাচ্ছেন। দুই পাশে বসে তার পা টিপছেন শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতা শামীম আজাদ ও শফিউল ইসলাম। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রেজাউল দাবি করেন, তিনি অসুস্থ থাকায় দুই নেতা তার সেবা করছিলেন।
রেজাউলের পা টেপার ঘটনাটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনার মূল বিষয় হয়ে উঠেছে। এমনকি শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছেন। তবে অজ্ঞাত কারণে এ নিয়ে চুপ-চাপ রয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি!
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, রেজাউল ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি ২০১০ সালে স্নাতক করেন। স্নাতকোত্তর ২০১৩ সালে।
ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার ৬ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই রেজাউল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এ পদের মেয়াদ এক বছর। কিন্তু রেজাউল এখনো সভাপতির পদে আছেন।
ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, ২০১৭ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলে অবৈধভাবে থাকছেন রেজাউল। হলের তিন সিটের ৩১১ নম্বর কক্ষটি তার একার দখলে রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের ছয় শিক্ষাবর্ষের মধ্যে স্নাতক শেষ করতে হবে। আর দুই শিক্ষাবর্ষের মধ্যে স্নাতকোত্তর। অর্থাৎ, একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ আট বছর ক্যাম্পাসে থাকতে পারবেন। কিন্তু রেজাউল প্রায় ১৭ বছর ধরে ক্যাম্পাসে আছেন।
ছাত্রত্ব না থাকা ব্যক্তিদের ১৫ মার্চের মধ্যে ক্যাম্পাস ও হল ত্যাগ করার বিষয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ১৫ মার্চের পর ছাত্রত্ব নেই-এমন কাউকে পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। বেঁধে দেওয়া এ সময়ের ৬ দিন পার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে নির্বিঘেœ অবস্থান করছেন রেজাউল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার বলেন, ‘হলের আসন দখলমুক্ত করতে আমরা কাজ শুরু করেছি। যাঁরা অবৈধভাবে অবস্থান করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা ইতিমধ্যে পুলিশের সঙ্গে বৈঠক করেছি।’
রেজাউলের সহপাঠীদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। এমনকি তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন। বয়স ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে প্রকাশ্যে তাঁকে অনেকেই ‘সমীহ’ করে চলেন।
যে দুই নেতা পা টিপছিলেন, তাঁদের সঙ্গে রেজাউলের বয়সের ব্যবধান অনেক। রেজাউল যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন ছাত্র, তখন দুই নেতা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন বলে জানা যায়।
দুই নেতার একজন শামীম শাখা ছাত্রলীগের উপকর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। তাঁর স্নাতক শেষ হয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে স্নাতকোত্তরও শেষ হয়ে যাবে।
অপর নেতা শফিউল শাখা ছাত্রলীগের উপক্রীড়া সম্পাদক। তিনিও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তিনি। তাঁর বিভাগে অ্যাকাডেমিক জট রয়েছে। এ কারণে তিনি সবে তৃতীয় বর্ষ শেষ করেছেন।
ছাত্রত্ব না থাকার পরও রেজাউল কীভাবে পদে রয়েছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘সম্মেলন জটের কারণে এমনটা হয়েছে। তবে আমরা নতুন সম্মেলনের মাধ্যমে নিয়মিত ছাত্রদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি।’
দুই নেতাকে দিয়ে রেজাউলের পা টেপানোর ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাদ্দাম বলেন, ‘বিষয়টি অসম্মানজনক ও বিব্রতকর।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি পক্ষে বিভক্ত। একটি পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর, আরেকটি সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন।
দুটি পক্ষ আবার ১১টি উপপক্ষে বিভক্ত। রেজাউল ছাত্রলীগের উপপক্ষ চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ারের নেতা। তিনি মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
গত বছরের ১৭ জুলাই রাত সাড়ে নয়টার দিকে ক্যাম্পাসে পাঁচ তরুণের হাতে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন। ভুক্তভোগী ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করেছিলেন পাঁচ তরুণ। এ ঘটনার মূল অভিযুক্ত আজীম হোসেন। তিনি রেজাউলের অনুসারী ছিলেন। এ ঘটনায় আজীমকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে।
নিপীড়নের শিকার ছাত্রীর ভাষ্য, আজীমকে বাঁচাতে ঘটনা আড়ালের নানা চেষ্টা চালিয়েছিলেন রেজাউল। তিনি প্রক্টর কার্যালয়ে অভিযোগ দেওয়া ও মামলা করতে তাঁকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন। এ নিয়ে গত বছরের ২৮ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘শুরু থেকেই ঘটনা আড়ালের চেষ্টা ছিল ছাত্রলীগ সভাপতির’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।