পরীক্ষায় অনিয়ম বিমানে, সোনা গায়েব বন্দরে
তাসনীয়া আজাদ : অনিয়ম যেন ছাড়ছেই না বাংলাদেশ বিমানের। কখনো নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে অনিয়ম, আবার কখনো বিমান বন্দরের শুল্ক বিভাগের লকার থেকে সোনাসহ মূল্যবান মালপত্র গায়েব! কে রুখবে এসব? কঠোর হওয়া বা দেখভাল করার কথা যাদের, তারাই জড়াচ্ছেন অনিয়ম আর লুটপাটে।
স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে এর আগেও একাধিকবার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ গত বছরের ২১ অক্টোবর ১০টি পদের জন্য নেওয়া একটি লিখিত পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পরে সেই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করে বিমান কর্তৃপক্ষ। এরই রেশ কাটতে না কাটতে আবারও বিমানে আরেকটি নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) রাজধানীর ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ‘গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট’ পদে লিখিত পরীক্ষা নেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। পরীক্ষার একটি কেন্দ্রের ৩ হাজার পরীক্ষার্থীর অনেকেই অভিযোগ করেছেন, ওই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগেই ফাঁস হয়েছে। প্রতিবাদে কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভও করেন তারা। যদিও বিমান কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। তবে অভিযোগের বিষয়ে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
অপরদিকে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগের লকার থেকে ৫৫ কেজির বেশি সোনা গায়েব হওয়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা ঢাকা শুল্ক বিভাগের নজরে আসে গত শনিবার (২ সেপ্টেম্বর)। একদিন পর অর্থাৎ রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) বিষয়টি জানাজানি হয়। এ ঘটনায় শুল্ক বিভাগ একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
আবারো বিমানে নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা :
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ‘গ্রাউন্ড সার্ভিস অ্যাসিস্ট্যান্ট’ পদে ১০০ জন নিয়োগ দেয়ার লক্ষে দরখাস্ত আহবান করা হয়েছিলো। এতে আবেদন পড়েছিল ৩৩ হাজার। গত শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বার) বেলা তিনটা থেকে পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু বেলা দুইটার দিকে পরীক্ষার্থীদের জানানো হয়, তিনটা নয়, পরীক্ষা শুরু হবে বিকেল চারটা থেকে।
পরীক্ষার সময় এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে বিমান কর্তৃপক্ষ জানায়, পরীক্ষার দিন ভোর থেকে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছিল। প্রশ্নপত্র তৈরি, তা ছাপানো ও ফটোকপি করাসহ পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে বিলম্ব হয়েছে। এ জন্য পরীক্ষা শুরুর সময় এক ঘণ্টা পিছিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, পরীক্ষা শুরুর সময় পিছিয়ে দেওয়ার তথ্য ১০টি কেন্দ্রে আগেই জানানো হয়। মন্ত্রণালয় ও সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও তা জানানো হয়। এর মধ্যে ৯টি কেন্দ্রে পরিবর্তিত সময়ে পরীক্ষা দিয়েছেন পরীক্ষার্থীরা। কিন্তু উত্তরা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে তিন হাজার পরীক্ষার্থী পরীক্ষা না দিয়ে কেন্দ্রের বাইরে গিয়ে বিক্ষোভ করেন।
বিমানের একটি সূত্র জানায়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে এর আগেও একাধিকবার অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।ে সর্বশেষ গত বছরের ২১ অক্টোবর ১০টি পদের জন্য নেওয়া একটি লিখিত পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পরে সেই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করে বিমান কর্তৃপক্ষ।
আগের সেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এতে বিমানের ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়।
শাহজালালে শুল্ক বিভাগের ৫৫ কেজির বেশি সোনা গায়েব :
হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগের লকার থেকে ৫৫ কেজির বেশি সোনা চুরির চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঢাকা শুল্ক বিভাগের নজরে আসে ২ সেপ্টেম্বর (শনিবার)। তবে বিষয়টি জানাজানি হয় ৩ সেপ্টেম্বর রোববার। এ ঘটনায় শুল্ক বিভাগ একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
শুল্ক বিভাগের ভাষ্য অনুযায়ী, চুরি হওয়া এসব সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু এত দিন ধরে এত পরিমাণ সোনা বিমানবন্দরের গুদামে রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের ভেতরে শুল্ক বিভাগে দুটি গুদাম বা লকার রয়েছে। এর মধ্যে নিচতলায় শুল্ক বিভাগের স্ক্যানার দিয়ে যাত্রীদের বের হওয়ার পথে তল্লাশি টেবিলের পাশে ছোট একটি লকার আছে। সেখানে মূলত তল্লাশির সময় তাৎক্ষণিকভাবে জব্দ করা পণ্য রাখা হয়। তবে সোনা বা বেশি মূল্যবান সামগ্রী হলে সেটা নিচতলায় ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার পাশেই শুল্ক হাউসের গুদামে নিয়ে রাখা হয়। গুদামের ভেতর আলাদা লকার রয়েছে। সোনা রাখার একটি লকার থেকে ৫৫ কেজির বেশি সোনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে উদ্ধার হওয়া।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, তাদের ধারণা, এক দিনে নয়, বিভিন্ন সময়ে লকার থেকে সোনা সরানো হয়েছে। এর সঙ্গে ভেতরের লোকজন জড়িত।
শুল্ক বিভাগ সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের ওই গুদাম পাহারায় ২৪ ঘণ্টায় চারটি পালায় (শিফট) তাদের কর্মীরা দায়িত্ব পালন করেন। শনিবার সকালে গুদামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন কর্মী গুদামে ঢুকে চিৎকার শুরু করেন। এরপর জানা যায়, লকার ভেঙে সোনা গায়েব করা হয়েছে।
ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ আমার বার্তাকে বলেন, ‘গুদামে অনেকগুলো লকার থাকলেও সোনা চুরি হয়েছে একটি লকার থেকে। এসব সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি গুদামে অটোমেশনের কাজ শুরু করি। এর মধ্যে এ ধরনের ঘটনায় আমি লজ্জিত ও বিব্রত।’
এই কর্মকর্তা জানান, আট দিন আগে গুদামটি অটোমেশনের কাজ শুরু হয়। এ কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা সোনা গণনার কাজ শুরু হয়। তাঁর ধারণা, সোনা চুরির ঘটনা আগেই ঘটেছে। গুদামের অটোমেশনের কাজ শুরু হওয়ায় সেটা ধরা পড়বে; তাই লকার ভাঙার ‘নাটক’ তৈরি করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন শুল্ক বিভাগে কাজ করেছেন এনবিআরের এমন একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আমার বার্তাকে বলেন, বিমানবন্দর থেকে চোরাচালানের সোনা উদ্ধার হলে সেটা জব্দতালিকা করে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে পাঠানো হয়। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিতে হয়, এরপর তারা সময় দিলে সেদিন কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সেখানে পৌঁছানো হয়। সাধারণত এক-দুই দিনের মধ্যে পাঠানো হয়। এর বাইরে যাত্রীদের আনা (ব্যাগেজ রুলের আওতায়) সোনার ঠিকভাবে শুল্ক পরিশোধ করতে না পারলে বা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি আনলে সেটা ছাড়িয়ে নেওয়ার আগপর্যন্ত ওই গুদামে রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতা বা আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে সোনা ছাড়িয়ে নিতে কারও কারও কয়েক মাস লেগে যায়। সাত-আট মাস বা এক বছরও লেগেছে, এমন ঘটনাও রয়েছে। কিন্তু চুরি হওয়া সোনার মধ্যে দু-তিন বছর আগের সোনাও ছিল বলা হচ্ছে। এত দিন রাখাটা স্বাভাবিক নয়।