বুয়েটে ছাত্রলীগের ‘নিশি’ অভিযান কেন?
(সোহরাব হাসানির বিশেষ লেখা, দৈনিক প্রথম আলো থেকে সংগৃহিত : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে একটানা ১৫ বছরেরও বেশি। দলটির ঘোষিত নীতি হলো, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’। সরকারের দাবি, দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা হয়েছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের বক্তৃতা বিবৃতিতে মনে হচ্ছে, সেই ‘নির্মূল হওয়া’ মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে) আস্তানা গেড়েছে! আর তাদের আস্তান ভেঙে দিতেই ছাত্রলীগকে সেখানে ‘নিশি’ অভিযান চালাতে হয়েছে।
ছাত্রলীগ যখন বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবি জানিয়েছে, তখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির হাল কি? প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিরোধী ছাত্র সংগঠন বিতাড়িত। সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনটিই সবখানে একক দৌরাত্ম্য দেখাচ্ছে। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতা–কর্মীদের পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠাচ্ছে।
গত বছর ১৩ ডিসেম্বর সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়ার পরদিন ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে পিটিয়ে আহত করেছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। আহত দুই নেতা হলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু ও সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ।
ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় বুয়েট পরিস্থিতি এখন থমথমে। রোববার সাধারণ শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত সমাবেশ করেনি। এটা কি শান্তির লক্ষণ না ঝড়ের পূর্বাভাস?
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ‘বুধবার রাত দেড়টায় বুয়েটের মূল ফটক দিয়ে মোটরসাইকেল ও গাড়ি নিয়ে ছাত্রলীগের অন্তত ৭০ থেকে ৮০ জন নেতা-কর্মী ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েন। তাঁরা ক্যাফেটেরিয়ার সেমিনার কক্ষে বৈঠক করেন, সেখানে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ছিল। মোটরসাইকেল, গাড়ি নিয়ে দীর্ঘসময় ক্যাম্পাসে ‘শোডাউন’ করেছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনও সেই ‘অভিযানে’ ছিলেন।’
এই অভিযানের পর বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হন। তারা শুক্র ও শনিবার ক্যাম্পাসে সমাবেশ করে পাঁচ দফা দাবির কথা বলেছেন। দুই দিনের পরীক্ষা বর্জন করেছে। বলা যায়, ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের যাওয়া নিয়ে বুয়েটে অচলাবস্থা চলছে।
সাধারণ ছাত্রদের ৫ দফা দাবির মধ্যে আছে: ১. মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ইমতিয়াজ রাব্বিকে বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার। রাব্বির পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া। ২. বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কীভাবে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেন, সে বিষয়ে প্রশাসনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। ৩.বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালকের (ডিএসডব্লিউ) পদত্যাগ। ৪. ৩০ মার্চের টার্ম ফাইনাল বর্জন এবং ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনালসহ সব একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন। ৫. আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো রকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি।
ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে ছাত্রলীগ বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি চালুর দাবিতে রোববার কেন্দীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছে। কিন্তু তারা কি বলবেন, কেন বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলো? অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও রাজনীতি করতেন। কিন্তু সেই রাজনীতির সুযোগে যখন আবরার ফাহদের মতো একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়, তখন সেখানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ না করে কী উপায় ছিল?
যেই ছাত্ররাজনীতি হওয়ার কথা ছাত্রদের কল্যাণে, সেই ছাত্ররাজনীতিই হলের ভেতরে একজন শিক্ষার্থীর জীবন কেড়ে নিল। এই রাজনীতি কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে থাকলে সেজন্য আর কাউকে দায়ী করা যাবে না। একমাত্র ছাত্রলীগই দায়ী।