সামরিক বাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিন : সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের

মনির হোসেন মিন্টু, এবিসিনিউজবিডি, ঢাকা (৪ আগস্ট ২০২৪) : ‘রাজনৈতিক সংকটকে সামরিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে’ মন্তব্য করে সাবেক সেনা কর্মকর্তরা এর বিরোধিতা করে সামরিক বাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

গতকাল রোববার (৪ আগস্ট) রাজধানীর রাওয়া ক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা তুলে ধরেছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা। দেশের বিদ্যমান অবস্থায় সংকট নিরসনে করণীয় প্রসঙ্গে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে চলমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা প্রকাশ করা হয়।

মূল বক্তব্যে ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, দেশের নীতিনির্ধারকেরা যদি বিবেক, বুদ্ধি ও হৃদয়হীন হয়ে না পড়তেন, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, করুণ, মর্মান্তিক হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ঘটত না। এসব হামলা, আক্রমণ ও পাল্টা প্রতিরোধে অঙ্গহানি ঘটেছে অগণিত মানুষের। অন্ধ হয়েছে বহুসংখ্যক কিশোর ও তরুণ। অসহায় নাগরিকেরা প্রয়োজনীয় ও জরুরি চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। তার ওপরে চলছে ব্লক রেইড করে, সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বাড়িঘর, মেস চিনিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর ঘটনা। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অথবা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন হাজার হাজার নিরপরাধ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী।

ইকবাল করিম ভূঁইয়া মূল বক্তব্য দেওয়ার আগে ছয়জন সাবেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বক্তব্য দেন। আর সমাপনী বক্তব্য দেন সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খান। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন লে. জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ।

সংবাদ সম্মেলনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানদের সুরক্ষা দিতে পারি নাই। এখনো সময় আছে। আর কারও যাতে প্রাণ না যায়। তবে আমাদের দায়িত্ব বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকেও রক্ষা করা। টেবিলে বসে ভাগাভাগি করে আমরা এই সেনাবাহিনী পাই নাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এই সেনাবাহিনী পেয়েছি। এই সেনাবাহিনী কারও ব্যক্তিগত স্বার্থে যাতে ব্যবহৃত না হয়। সেই দিকে আমাদের খেয়াল রাখা সবচেয়ে জরুরি।’

মেজর জেনারেল (অব.) জামিল ডি আহসান (বীর প্রতীক) বলেন, ‘একটি এপিসি থেকে একটি ছেলেকে কীভাবে ফেলে দেওয়া হলো! কী বাহিনী বানিয়েছি আমরা! আমাদের পুলিশ কী রকম অমানুষের মতো আচরণ করেছে, তা আমরা সবাই দেখেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রাচুর্য ছিল না, প্রাণ ছিল। এই সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে, এটা আমাদের কারও কাম্য নয়। সেনাবাহিনী একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান, একে বিতর্কিত করা ঠিক হবে না। গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এই আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। হ্যাঁ, অবশ্যই এটা রাজনৈতিক আন্দোলন। দেশের এর আগের সবগুলো ছাত্র আন্দোলনই রাজনৈতিক আন্দোলন।’

মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান (বীর উত্তম) বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি এমন একটি সংবাদ সম্মেলনে আমাকে আসতে হবে। আমি পরিবার থেকে প্রচ- চাপের মুখে পড়েছি। আন্দোলন হচ্ছে তা আমি দেখেছি, পড়েছি। কিন্তু এটা এমন জায়গায় পৌঁছাবে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। যে ঘটনাটা হয়ে গেল, তার পেছনের দিকে আমরা যদি তাকাই, তাহলে আমরা দেখি, আমরা প্রথমে তাদের সঙ্গে কী ব্যবহার করলাম। যেসব স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা দেখে মনে হয়েছে, তা পুড়িয়ে দিতে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সবাইকে চিন্তা করতে হবে, আর যাতে রক্তপাত না হয়।’

আজিজুর রহমান আরও বলেন, ‘আমি ২৫ বছর হয়েছে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছি। কাউকে গুলি করার আগে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ও সহায়তা নেওয়া হতো। তাঁরা দেখিয়ে দিতেন, কে দুষ্কৃতকারী; আর পায়ের নিচে গুলি করতে হবে। কিন্তু এখন তো পাখি শিকার করার মতো করে মানুষ মারা হয়েছে। আমরা এর আগে দেখেছি, সর্বশেষ অবস্থায় সেনাবাহিনীকে নামানো হয়। যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল, তাতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ছিল পরিস্থিতি সামলানো। তারা যদি না পারে, তাহলে এসব বাহিনীর কী দরকার?’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খান বলেন, ‘দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা এড়ানো যেতো। সেনাবাহিনীকে জনগণের প্রতিপক্ষ করা যাবে না। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। আমরা চাই না আমাদের ভাইয়েরা মনে করুক, সেনাবাহিনী তাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।’ তিনি বর্তমান সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘সেনাপ্রধান বলেছেন, “সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে থাকব।” কিন্তু জনগণের পক্ষে থাকতে হলে জনগণের দিকে বন্দুক তাক করে নয়। জনগণের পাশে থাকা মানে জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া। বিদেশে আমাদের সেনাবাহিনী যুদ্ধের মধ্যে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দিচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেনাপ্রধানের কথা যাতে মাঠে সত্যিকার অর্থে এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, সেটাই আমরা দেখতে চাই। সেনাবাহিনী জনগণের সত্যিকার অর্থে পাশে থাকবে, সেটাই আমার প্রত্যাশা।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ