বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষীরা ভয়ে
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ বিচার শেষ পর্যায়ে আসার মধ্যে এক সাক্ষীকে মারধরের পর বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের অন্য সাক্ষীরা আতঙ্কে আছেন বলে অভিযোগ করেছেন আইনজীবী।
আগামী মাসেই বিচার শেষের আশা প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি এস এম রফিকুল ইসলাম বহুল আলোচিত এই মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন।
গত ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধের সময় সরকার সমর্থক ছাত্রলীগকর্মীদের হামলায় বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের এই মামলায় সোমবারও প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুবুল আলমের সাক্ষ্যগ্রহণ চলে।
রোববার জবানবন্দি দেয়া এই পুলিশ কর্মকর্তাকে এদিন জেরা করেন আসামি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের আইনজীবীরা।
জেরা অসমাপ্ত রেখেই মামলার শুনানি মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. নূরুজ্জামান।
দ্রুত বিচারের জন্য আলোচিত এই মামলাটি এই বছরের মাঝামাঝিতে জজ আদালত থেকে দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।
এই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রফিকুল ইসলাম এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, “সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেয়ার কথা পুলিশের। অথচ পত্রিকায় দেখলাম, সাক্ষী রিপন সরকারকে পুলিশ মারধর করেছে।”
পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে দরজি দোকানি বিশ্বজিৎকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখমের পর রিকশাচালক রিপন তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি এই আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে যাওয়া রিপন দুদিন আগে সদরঘাটে পুলিশি নির্যাতনের স্বীকার হন। আইনজীবী রফিকুল নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন।
এই হত্যামামলার ২১ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার আটজনকে সনাক্ত করেন রিপন মিয়া।
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, অধিকাংশ সাক্ষী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কেউ চায়ের দোকানি, কেউ গাড়িচালক, কেউবা ঝাড়ুদার।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি তার অভিযোগ ঢাকার মহানগর পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মামলার কার্যক্রম ও সাক্ষীদের তদারকির দায়িত্ব পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) মিরাস উদ্দিন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক তাজুল ইসলামকে দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পলাতক আসামি ছাত্রলীগ নেতাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আইনজীবী রফিকুল বলেন, “অনেক সাক্ষী আসামিদের ভয়ে সত্য কথা বলতে পারছেন না। হত্যার হুমকি নিয়ে আদালতে আসতে হচ্ছে তাদের।
“মামলার কার্যক্রম শেষ হতে চলছে। অথচ পলাতক ১৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করছে না পুলিশ। পলাতক আসামিরা ও তাদের লোকজন সাক্ষীদের ভয় দেখাচ্ছে।”
রফিকুল ইসলাম আশা করছেন, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার বিচার শেষ হতে পারে।
“গুরুত্বপূর্ণ সব সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত তদন্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম এ মাসেই সাক্ষ্য দেবেন। তারপর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন, সবশেষ ধাপে দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পরই রায়।”
মামলার দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক তাজুল সোমবারও আদালতে হাজির ছিলেন। তবে প্রথম তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হওয়ায় তার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।
মাহবুবুল রোববার হত্যাকাণ্ডের সময়কার বেসরকারি টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র সিডি ও ডিভিডি হিসেবে এবং দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনগুলো সম্বলিত খাতা প্রদর্শনী হিসেবে আদালতে দাখিল করতে গেলে আসামিপক্ষের বিরোধিতার মুখে পড়েন।
২০০০ সালের দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল আইনের ১৬ ধারায় এসব উপাত্তের সাক্ষ্যগত মূল্য থাকলেও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়ম অনুযায়ী এসব জিনিস জব্দ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেননি বলে আসামি পক্ষের অভিযোগ।
বিচারক পরে ওই সব তথ্যপ্রমাণ ‘প্রদর্শনী’ হিসাবে না নিয়ে ‘চিহ্ন’ হিসাবে নথিপত্রে যুক্ত করেন।
১৩ আসামি গ্রেপ্তার নেই ১০ মাসেও
ব্যাপক আলোচনায় থাকা এই ঘটনার ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও বিশ্বজিৎ হত্যামামলার বেশির ভাগ আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশের খাতায় তারা পলাতক হলেও আসামিদের কেউ কেউ মাঝে মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যান বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা কিন্তু তৎপর রয়েছি। ১৩ জন পলাতক আসামির বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা আছে। তা প্রত্যেক আসামির থানায় পাঠানো হয়েছে।
“আমরা নিয়মিত সংশ্লিষ্ট থানায় খোঁজ নিয়ে থাকি। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
পলাতক ১৩ আসামি হলেন রাজন তালুকদার, ইউনুস আলী, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, আজিজুর রহমান, আলাউদ্দিন, ইমরান হোসেন, মীর নূরে আলম লিমন, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, কামরুল হাসান, তারিক বিন জোহর তমাল, মনিরুল হক পাভেল ও মোশাররফ হোসেন।
মামলার আট আসামি গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তারা হলেন- রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, এ এইচ এম কিবরিয়া, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা ও গোলাম মোস্তফা।
এর মধ্যে এমদাদ, শাকিল, শাওন ও নাহিদ বিচারকের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।