ব্ল্যাক স্যাবাথ: হেভি মেটালের ঈশ্বর
বিনোদন ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ ষাট দশকের শেষদিকে ইংল্যান্ডে তখনকার প্রচলিত ধারা থেকে বাইরে এসে শুরু হয় এক নতুন ধরনের সংগীতচর্চা। ব্লুজ রক জনরার সঙ্গে হেভি গিটার ডিস্টরশন এবং ড্রামিংয়ের প্রগ্রেশনে আবির্ভাব ঘটে বেশ কয়েকটি ব্যান্ডের। ‘লেড জ্যাপলিন’, ‘ডিপ পার্পল’ এবং‘ ব্ল্যাক সাবাথ’ হল ওইসব ব্যান্ডের অন্যতম, যারা তাদের নতুন মিউজিক্যাল স্টাইল এবং কম্প্যাক্ট প্লেইংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিল এক নতুন উন্মাদনা।
ষাট দশকের মাঝামাঝিতে নিজস্ব মিউজিকের উন্মাদনা দিয়ে নতুন ধরনের যে সংগীতশৈলী তৈরি করেছিল ‘দ্য বিটলস’।
সেটিই বলতে গেলে ওই তিনটি ব্যান্ড নতুন করে ফিরিয়ে আনে, যা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ‘হেভি মেটাল যুগ’-এর সূচনা হিসেবে।
কেইবা ভেবেছিল, এই তিনটি নতুন ব্যান্ড, যাদের মিউজিককে বলা হয়েছিল শয়তানের উপাসনা, সেই ব্যান্ডগুলোই আজ সবচেয়ে সেরার কাতারে! তখন থেকেই বিতর্কের শুরু, এদের মধ্যে সেরা কে? কে এই হেভি মেটালের জনক?
তবে সকল বিতর্ক ছাপিয়ে কিংবদন্তি এই তিনটি ব্যান্ড থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ উপাধি নিয়ে বেরিয়ে আসে ‘ব্ল্যাক সাবাথ’; যারা ১৯৬৮ সালে তাদের ব্যান্ড শুরুর ৩৫ বছর পরও নতুন অ্যালবাম দিয়ে কাঁপিয়ে তোলে বিশ্বকে। ভেঙে দেয় টপ চার্টগুলোর রেকর্ড! ‘রোলিং স্টোনস’ ম্যাগাজিনের মতে ‘দ্য বিটলস অফ হেভি মেটাল’ কিংবা এমটিভির তালিকায় ‘দ্য গ্রেটেস্ট হেভি মেটাল’ ব্যান্ডের স্বীকৃতি পাওয়া ব্ল্যাক সাবাথ বিশ্বের মেটাল হেডদের কাছে পূজনীয়, ঈশ্বরতুল্য!
‘রেয়ার ব্রিজ’ ব্যান্ডের গিটারিস্ট টমি আইওমি এবং ড্রামার বিল ওয়ার্ড হঠাৎ করেই ব্যান্ডটিতে নিয়ে আসলেন ভোকাল ওজি অজবোর্ন এবং বেজিস্ট গিজার বাটলারকে। যেখান থেকেই মূলত সূচনা হয় ‘ব্ল্যাক সাবাথের’ এবং এই চারজনের লাইন আপকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয় সাবাথের ‘দ্য ক্লাসিক’ লাইনআপ হিসেবে। হাস্যকর হলেও সত্য, প্রথমদিকে অজবোর্ন তার মায়ের ট্যালকম পাওডারের নাম থেকে ব্যান্ডের নাম রেখেছিলেন ‘দ্য পলকা ট্যাল্ক ব্লুজ ব্যান্ড’; যদিও পরে ব্যান্ডের নাম রাখা হয় ‘আর্থ’।
তবে এ ধরনের নাম আইওমির পছন্দ হয়নি একেবারেই। একদিন হরর মুভি দেখার ফাঁকে সেই মুভির নামেই ব্যান্ডের নাম রেখে বসেন ‘ব্ল্যাক সাবাথ’। এর পরপরই শুরু হয় ব্ল্যাক সাবাথের মিউজিক্যাল ক্যারিয়ার। ক্লাব এবং পাবগুলোতে বাজাতে গিয়ে খুব তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তারা।
অজবোর্নের ডুমি ভোকাল, ডান হাতে আঙ্ুল না থাকা সত্ত্বেও প্রস্থেটিক দিয়ে আইওমির ডেভিলিস গিটার প্লেইং এবং সঙ্গে তার সিগনেচার ‘দ্য ডেভিল ইন্ট্যারভ্যাল টোন’, বাটলারের দুর্দান্ত লিরিক আর বেইজ প্লেইং এবং ওয়ার্ডের হেভি ড্রামস বিট– সব মিলিয়ে অনবদ্য ‘ব্ল্যাক সাবাথ’ তাদের গানে নিয়ে আসে সামাজিক অসংগতি, ভৌতিক আবহ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধবিগ্রহ এবং এর ভয়াবহতা।
দুই বছরের মাথায়, ১৯৭০ এ বের হয় তাদের সেলফ টাইটেলড অ্যালবাম ‘ব্ল্যাক সাবাথ’।
হেভি মেটালের উন্মাদনায় সাফল্য লাভ করে অ্যালবামটি। একই বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে তারা বের করে তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘প্যারানয়েড’; যে অ্যালবামটিকে পরবর্তীতে অনেক মিউজিশিয়ান এবং ক্রিটিকরা স্বীকৃতি দিয়েছেন ‘দ্য বার্থ অফ হেভি মেটাল’ হিসেবে। ‘প্যারানয়েড’ গানের সঙ্গে সঙ্গে তখন ‘ব্ল্যাক সাবাথ’-ভক্তরা আদিম উন্মাদনায় মেতে উঠত তাদের কনসার্টে; ‘আয়রন ম্যান’ গানটি তখন ব্ল্যাক সাবাথের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান, যেটি আবার ২০০৮ সালে ‘আয়রন ম্যান’ মুভির টাইটেল ট্র্যাক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল।
এর পরেরটুকু ইতিহাস। ১৯৭০ সালের পর শুরু হয় তাদের ইন্টারন্যাশনাল ট্যুর। রিলিজ হয় ‘মাস্টার অফ রিয়ালিটি’, ‘ভলিউম ৪’, ‘সাবাথ ব্লাডি সাবাথ’, ‘সাবোটাজ’-এর মতো অসাধারণ অ্যালবাম। এবং এরই সঙ্গে শুরু হয় ব্যান্ডের ভাঙাগড়ার খেলা।
‘টেকনিক্যাল এক্সটেসি’ রিলিজের পরপরই ১৯৭৭-এ ব্যান্ডের উপর আগ্রহ হারিয়ে চলে যান ওজি; আবার ফিরেও আসেন ১৯৭৮-এ। কিন্তু মাদকের আসক্তির কারণে আইওমি বাধ্য হয়ে ১৯৭৯ তে বের করে দেন ওজিকে, ব্ল্যাক সাবাথের জন্য একটা চরম ধাক্কা ছিল ওজির মতো ভোকালকে হারানো। কিন্তু ওজি গড়েন আরেক ইতিহাস, তার ‘ওজি অজবোর্ন’ নামের আরেকটি হেভি মেটাল ব্যান্ড দিয়ে! তবে কেউ এটা ভাবতে পারেনি, ওজির জায়গায় আসবেন আরেকজন জীবন্ত কিংবদন্তি; তখনকার অন্যতম জনপ্রিয় রক ব্যান্ড ‘রেইনবো’-র ভোকাল রনি জেমস ডিও। ওইসময় ‘ব্ল্যাক সাবাথ’-এ রনির সংযুক্তিটা বেশ বড় ধরনের ঝড় তুলেছিল ভক্তদের মধ্যে। এত কিছুর মধ্যে বাটলার একবার চলে গেলেও আবার ফিরে আসেন ১৯৮০ সালে। ওই বছরই বের হয় তাদের নবম অ্যালবাম ‘হেভেন অ্যান্ড হেল’; ব্ল্যাক সাবাথের পুরনো সাফল্য ফিরে আসে এই অ্যালবাম রিলিজের পর। কিন্তু বিধি বাম, এবার ব্যান্ড ছাড়েন বিল ওয়ার্ড। এবং ব্যান্ডে আসেন ভিনি এপিস, রিলিজ হয় ‘মব রুলস’।
ডিও এই অ্যালবামের পরেই এপিসকে নিয়ে চলে যান ব্যান্ড থেকে, গড়ে তোলেন তাদের নিজেদের ব্যান্ড ‘ডিও’ যেটি আরও একটি দুর্দান্ত ব্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বড় ধরনের আকস্মিক চমক দেখিয়ে ‘ডিপ পার্পল’ ছেড়ে সাবাথে আসেন ভোকাল ইয়ান গিলিয়ান, সেই সঙ্গে ওয়ার্ডও ফেরেন তার পুরনো ঘরে। বের হয় তাদের নতুন অ্যালবাম ‘বর্ন এগেইন’। ওদিকে যে রকম হঠাৎ করে এসেছিলেন, ঠিক সে রকমভাবেই গিলিয়ান আবার সাবাথ ছেড়ে চলে যান ডিপ পার্পলে। ক্রমাগত সদস্যদের চলে যাওয়ার কারণে বিরক্ত হয়ে আইওমি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ব্যান্ডের ‘হায়াটাস’ অর্থাৎ সাময়িক বিরতি ঘোষণা করেন।
পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালের দিকে এক্সডিপ পার্পল ভোকাল গ্লেন হিউজেসকে নিয়ে রিলিজ হয় সাবাথের বারতম অ্যালবাম ‘সেভেনথ স্টার’।
কিন্তু সাবাথের পুরনো সেই আবহ অদৃশ্যই রয়ে যায়। ওই সময় একবার আহত হয়ে গ্লেন ব্যান্ড ছাড়েন, তার জায়গায় আসেন টনি মার্টিন।
মার্টিনের সঙ্গে ‘দ্য ইটার্নাল আইডল’, ‘হেডলেস ক্রস’, ‘ট্যায়ার’-এর মতো অ্যালবাম বের হয়।
কিন্তু ১৯৯০ সালে অনেকটা বোম ফাটার মতো খবর আসে, সাবাথের ‘মব রুলস’-এর লাইন আপটির রিইউনিয়ন হচ্ছে। ফিরে আসেন ডিও, বাটলার ও এপিস। বের হয় ‘ডিহিউম্যানিজার’ অ্যালবাম। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই যা কাঁপিয়ে তোলে বিশ্বকে। অবশ্য এই উন্মাদনা ছিল অল্পসময়ের জন্য; কেননা ডিও এরপর চলে যান আবার। টনি মার্টিন ১৯৯৫ পর্যন্ত আরও দুটি অ্যালবামে কাজ করেন।
১৯৯৭ সালে হঠাৎ করেই ‘ওজি অজবোর্ন’-এর একটি শোতে রিইউনিয়ন হয় সেই পুরনো ক্ল্যাসিক লাইন আপ টির; ‘আয়রন ম্যান’ পারফর্ম করে মাতিয়ে ফেলেন কনসার্টে আসা সবাইকে এবং পারফরম্যান্সটি জিতে নেয় গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড। কিন্তু ভক্তদের আরও একবার হতাশ করে দিয়ে ২০০১ সালে আবার ওজির সঙ্গে দ্বিমতের কারণে মোটামুটি পর্দার আড়ালে চলে যায় ব্যান্ডটি।
২০০৬ সালে ডিওর সঙ্গে ‘ডিহিউম্যানাইজার’-এর লাইন আপ আবার একত্র হয় এবং ‘হেভেন এন্ড হেল’ নামে তারা ‘ডা ডেভিল ইউ নো’ অ্যালবাম রিলিজ করে। কিন্তু ২০১০ এ ডিও মারা যাওয়ার পর ‘হেভেন এন্ড হেল’ আর কোনো অ্যালবাম রিলিজ করেনি।
২০১১ সালে আবার ক্ল্যাসিক লাইনআপের একত্রিত হয় এবং নতুন অ্যালবামের কাজ শুরু করে। যদিও পরে আবার ওয়ার্ড চলে যান এবং তার জায়গায় আসেন রেইজ এগেইন্সট দ্য মেসিনের ড্রামার ব্র্যাড উইল্ক। ২০১৩ সালে বের হয় তাদের ১৯তম অ্যালবাম ‘১৩’।
ভেঙে দেয় অতীত সব রেকর্ড। যে ব্ল্যাক সাবাথকে তার ভক্তরা পাগলের মতো ভালোবাসত, সেই ব্ল্যাক সাবাথ তাদের সেই পুরনো ডামি এবং ডার্ক স্টাইল ফিরিয়ে নিয়ে আসে তাদের গানে।
৭০ মিলিয়নেরও বেশি অ্যালবাম বিক্রির রেকর্ডধারী কিংবদন্তি এই হেভি মেটাল ব্যান্ড অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে অন্যান্য ব্যান্ডকে। ‘নিও ওয়েভ অফ ব্রিটিশ হেভি মেটাল’, ‘গ্ল্যাম মেটাল’, ‘থ্র্যাস মেটাল’, ‘ডেথ মেটাল’ থেকে শুরু করে ‘গ্রাঞ্জ’, ‘অল্টার রক’, ‘প্রগ্রেসিভ রক’– এ রকম আরও অসংখ্য জনরার অসংখ্য ব্যান্ড তাদের অনুপ্রেরণার উৎস খুঁজে নেয় এই ব্ল্যাক সাবাথের কাছ থেকেই।
হয়তো এই ব্যান্ড না আসলে জন্ম হত না আরও অনেক কিংবদন্তি ব্যান্ডের, এ রকম মেটাল বিপ্লবের কথাও কল্পনা করা যেত না! ‘ব্ল্যাক সাবাথ’ এখন তাই তাদের নিজস্ব মিউজিকাল স্টাইল, ইতিহাস সব দিক দিয়েই এক জীবন্ত কিংবদন্তি।