সর্বদলীয় সরকারের গন্তব্যে অনিশ্চিত

সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ ‘সর্বদলীয় সরকার’ গঠনের মাধ্যমে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার পথ সুগম হয়েছে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট। চলছে নির্বাচনের প্রস্তুতিও। আবার এই ‘সর্বদলীয় সরকার’ ইস্যুতেই ভাঙন দেখা দিয়েছে মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় পার্টিতে। দলের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদত্যাগের ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

এদিকে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে ‘সর্বদলীয় সরকার’ নিয়ে বিপাকে রয়েছে শাসকদল আওয়ামী লীগও। কখনো হামলা-মামলা, আবার কখনো মন্ত্রিসভার সদস্যপদ ও নির্বাচনী ব্যয় বহনের টোপ দিয়েও সর্বদলীয় সরকারে অনেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।

মহাজোটের শরীক দলের বাইরে  প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ সংসদের ভেতরে-বাইরে আন্দোলন-সংগ্রামে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর অংশগ্রহণ না থাকায় সর্বদলীয় সরকারের নৈতিকতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি  সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন  সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।  এ নিয়ে বিব্রত খোদ মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্য। এ  সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে কি-না বা নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবে কি-না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাই নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিরোধীদলের মরণপণ আন্দোলন ও দাতাগোষ্ঠীর চাপে ‘সর্বদলীয় সরকারের’ যাত্রা অনিশ্চিত গন্তব্যে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত ১৮ দলীয় জোট বেশকিছু দিন ধরেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করলে দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায়  একতরফা নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে সারাদেশে টানা ৪৮ ঘণ্টা রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের ডাক দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট।

সোমবার সিইসির তফসিল ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।  তিনি বলেন, প্রহসনের নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট অংশ নেবে না  এবং কমিশনকে এ তফসিল স্থগিত রাখার আহ্বান জানান।

এদিকে পাল্টাপাল্টি তফসিল ও অচল কর্মসূচি ঘোষণায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারাদেশে। সোমবার রাতে টঙ্গীর আব্দুল্লাপুরে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেয় দুবৃত্তরা। অবরোধের প্রথম দিনে বগুড়া, ফেনী ও চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা নির্বাচন কমিশন অফিসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

মঙ্গলবার  কুমিল্লায় ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ-বিজিবির সংঘর্ষে  রিপন নামে এক বিজিবি সদস্যসহ সারাদেশে ৮ জন নিহত হয়। রেললাইনের স্লিপার তুলে ফেলায় চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকা-সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আগুন দেওয়া হয় রেলের পাঁচটি বগিতে।

এদিকে  এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর আহমদের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বানে আবারও বেকায়দায় পড়ে ‘সর্বদলীয় সরকার’।

কাজী জাফরের বিবৃতিকে এরশাদ ব্যক্তিগত অভিমান বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মঙ্গলবার কাজী জাফর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় পার্টি থেকে তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আমি আর এরশাদের জাতীয় পার্টিতে নেই। সত্যিকারের জাতীয় পার্টিতে আছি। তিনি নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে তার আগের  অবস্থানে অনড় থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।

একইদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় পার্টিকে ‘জাতীয় বেঈমান পার্টি’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগ করেন আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা মুজিবুর রহমান যুক্তিবাদী।

তিনি বলেন, এরশাদ বিশ্বাসঘাতক, মেরুদণ্ডহীন, বিশ্ববেহায়া ও আওয়ামী লীগের গৃহপালিত। জাতীয় পার্টির ভাঙন সর্বদলীয় সরকারের অস্তিত্বের ওপর চরম আঘাত বলে রাজনীতি বিশ্লেষকরা দাবি করছেন।

সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেয়ে যেনতেনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এজন্য সরকার তরফে বিরোধীদলের প্রতি হুঙ্কার দিলেও তৃণমূলের পাশাপাশি শীর্ষ নেতৃত্বেও হতাশা বিরাজ করছে।  কারণ ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বিএনপির একদলীয় নির্বাচন প্রায় হয়েই যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছিল। পরে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপির বেশ কয়েকজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারও শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু উপদেষ্টা হিসেবে ইয়াজউদ্দিনের নির্বাহী ক্ষমতা  বিলুপ্তির পাশাপাশি নির্বাচন বন্ধ হয়।

বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড বজলুর রশীদ ফিরোজ এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, একতরফা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার গায়ের জোরে নির্বাচন করতে পারবে না। ৮৬, ৮৮ ও ৯৬ সালেও একদলীয় নির্বাচন হয়েছিল। তবে খালেদা-হাসিনার ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা রক্ষার রাজনীতিতে অগতান্ত্রিক শক্তি আবারও ওয়ান-ইলেভেনের ন্যায় ওঁৎ পেতে আছে।

বাংলাদেশে অতীতে অরাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে রাজনীতি বা গণতন্ত্রের সঙ্কটাপন্ন সময়ে। কোনো না কোনো রাজনৈতিক শক্তির  মদদেই তা ঘটেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপকে জনগণ স্বাগত জানায়-এমন উদাহরণ এদেশে রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়।  রাজনৈতিক অবস্থা বিস্ফোরণোন্মুখ থাকলে জিএসপি সুবিধা বাতিল ও জাতিসংঘে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে জানানো হয়।

তাছাড়া গত ২০ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে দেশটি নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের চাপের মুখে পড়বে। একারণে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানি বন্ধ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অর্ন্তবর্তী সরকার বিরোধীদলের সঙ্গে কাজ করার জন্য শেখ হাসিনা সরকারকে তাগিদ দেওয়া হয়।

এদিকে বিরোধীদলের ক্রমবর্ধমান আন্দোলন ও সঙ্কটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আর্ন্তজাতিক বিশ্বের উৎকণ্ঠায় বর্তমান সর্বদলীয় সরকারের স্থায়ীত্ব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশারেফা মিশু।

এবিসি নিউজ বিডিকে তিনি বলেন, একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ দেশের জন্য সুখকর নয়। সমঝোতার সম্ভাবনা দেখছি না। পরিস্থিতি খারাপ। দিন দিন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। সরকার নির্বাচন করতে পারবে কিনা বা নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবে কিনা তা আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সব সন্দেহ উড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, কোনো অশুভ শক্তিই নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। নিধারিত সময়ে নির্বাচন হবে। জনগণের সমর্থনে আওয়াম লীগ আবারও সরকার গঠন করবে বলে আমরা আশাবাদী। বিগত দিনের মতো এ সরকার দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজ করে যাবে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ