ট্রাইব্যুনালের ৯ কর্মকর্তা আ’লীগের মনোনয়ন কেনায় সমালোচনার ঝড়
সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার সদস্যদের মধ্যে নয় কর্মকর্তার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কেনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তাদের ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন চাওয়া অনৈতিক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ট্রাইব্যুনালের বিচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট নয় কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনেছেন। তাদের মনোনয়ন কেনা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
জানা যায়, প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা ছাত্রজীবনের বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।এখনো সক্রিয় রয়েছেন।
এদিকে তদন্ত কর্মকর্তারা পুলিশ বাহিনীতে দ্বায়িত্ব পালনের পর অবসরে গিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের পাঁচজন, তদন্ত সংস্থার তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং ট্রাইব্যুনালের নিযুক্ত একজন আইনজীবী ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
গত ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র বিক্রির প্রথম দিনে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক মো. আবদুল হান্নান খান নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসন, সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এম. সানাউল হক কিশোরগঞ্জ-৩ (তাড়াইল-করিমগঞ্জ) এবং অন্য কর্মকর্তা আব্দুর রহিম ময়মনসিংহ-৮ (ইশ্বরগঞ্জ) আসনের মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল হান্নান খান ২০০৮ সালে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি নেত্রকোনা-৫ আসন থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে ১৮ হাজার ভোট পেয়ে পরাজিত হন। ২০০০ সালে ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি পদ থেকে তিনি অবসরে গেলেও ২০১১ সালে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে তদন্ত সংস্থার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্য কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম। তিনি ডিআইজি পদ মর্যাদায় ট্রাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থায় কাজ করছেন বলে জানান। ৬৯-এ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
গত ১৪ নভেম্বর প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ঢাকা-২০ (ধামরাই) আসনের জন্য মনোনয়ন কিনেছেন। এর আগে গত ১০ নভেম্বর সুলতান মাহমুদ সীমন শরীয়তপুর-২ (নডড়িয়া-সখীপুর) আসন, মোখলেছুর রহমান বাদল কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসন, নূরজাহান বেগম মুক্তা চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) আসন এবং সৈয়দ সায়েদুল হক হবিগঞ্জ-৪ (চুনারঘাট-মাধবপুর) আসনের মনোনয়নপত্র কিনেছেন।
অন্যদিকে রাষ্ট্র নিযুক্ত পালতক ও ট্রাইব্যুনালের বিচারে অনুপস্থিত আসামিদের পক্ষের আইনজীবী সালমা হাই টুনি মুন্সিগঞ্জ-৩ গজারিয়া আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী।
বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আলী বর্তমানে আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য। নড়িয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি পরাজিত হন।
আনন্দমোহন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোকলেছুর রহমান পাকুন্দিয়া আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
নূরজাহান মুক্তা বর্তমানে মহিলা আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। সৈয়দ সায়েদুল হক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন। অন্যদিকে সালামা হাই টুনির নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবার পরিচিতির সুবাধে তিনি তার মনোনয়ন পেতে পারেন বলে আশাবাদী। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষকলীগের সম্পাদিকা, ঢাকা বারের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পদিকা, সুপ্রিমকোর্ট আওয়ামী আইনজীবী প্রচার সম্পাদক, মুন্সিগঞ্জ জেলা আইন-শৃংখলা নিয়ন্ত্রক কমিটির সদস্য এবং সুপ্রিমকোর্ট আওয়ামী মহিলা আইনজীবীদের সেক্রেটারি।
তারা সবাই এবিসি নিউজ বিডিকে জানান, নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পেলে তারা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর টিম থেকে পদত্যাগ করবেন।
প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনে সংসদ নির্বাচন করলে সমালোচনার মুখে পড়বেন কি-না জানতে চাইলে এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রসিকিউশনের সদস্য তুরিন আফরোজ এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, আমি মনে করি যদি কেউ দ্বায়িত্ব নিয়ে দেশের সেবা করতে চান; তাহলে তারা ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। এখানে থেকে নির্বাচন করাটা সঠিক মনে হচ্ছে না।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, বিধান আছে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। যদি কোনো কর্মকর্তা একটি আদালতের প্রসিকিউটরের দ্বায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে কোনো রাজনৈতকি দলের নমিনেশন নেন, তহলে বুঝতে হবে তার রাজনৈতিক দলের আনুগত্য আছে।
বিশিষ্ট আইনবিদ ড. শাহদীন মালিক এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, এমনিতে ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং বিচারপতি ও বিচার কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে আরেকটি সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন।
তবে সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ মনে করেন, এতে বিচার নিয়ে বিতর্ক হওয়ার কিছু নেই। বিচার করবেন বিচারক, আইনজীবী নন।
আওয়ামী লীগের একাধিক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, শুধু দলীয় পরিচয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে দ্বায়িত্ব পেয়েছেন অনেকে। এখন তারা আবার এমপি হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন।