সবার দৃষ্টি সরকারের দিকে

সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ নির্বাচনের পরও রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের রেশ না কাটতেই সংসদ বহাল রেখে সরকার গঠনের সিদ্ধান্তকে অনেকেই সাংবিধানিক জটিলতা হিসেবে দেখছেন। সমালোচনার মুখে পড়ছে সরকার ।

সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা কেমন হবে তা নিয়েও রয়েছে ধুম্রজাল। আবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন পুনর্নির্বাচনের দাবি আদায়ে অব্যাহত রয়েছে বিরোধী দলের অবরোধ। প্রতিনিয়ত সরকারি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বিরোধী নেতাকর্মীরা। আসছে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ। এ পরিস্থিতিতে কী করবে সরকার? কোন পথে যাবে? সরকারের গৃহীত নীতির অনিবার্য পরিণতি কী সংঘাত না শান্তি? তাই  সঙ্কট নিরসনে সবার দৃষ্টি এখন সরকারের দিকে।

সংবিধানে বলা আছে, সব পরিস্থিতিতে একটি সংসদ থাকবে। শুক্রবার থেকে আগামী রোববার পর্যন্ত দেশে কোন সংসদের নেতা এবং কোন সংসদের প্রধানমন্ত্রী বহাল থাকবেন তা নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিরোধী জোটের রাজনীতিকরা বলছেন, বাংলাদেশে দুটি সংসদ এবং মন্ত্রিসভা বহাল আছে।

বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা নির্বাচিত হয়েছেন দশম সংসদের নেতা। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন রোববার। কিন্তু তিনি এখনও পদত্যাগ করেননি। সংসদীয় রেওয়াজ হচ্ছে, নির্বাচনের আগে বা পরে হলেও প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য করতে হবে। পদ শূন্য না হলে রাষ্ট্রপতি কাকে কী পদে নিয়োগ দেবেন? তবে স্পিকার শিরিন শারমিন কী করে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পড়ালেন তাও এক বিরাট বিস্ময়।

সরকারের ব্যাখ্যাদাতারা এবারে সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। সাংবিধান রক্ষার আর্তনাদ এখনও শোনা যায়নি। স্পিকার বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নীরব ছিলেন। তার দফতরে গিয়ে সাংবাদিকেরা জানতে  চান, আপনি কীভাবে সংবিধানের ১২৩(৩) এবং ১৪৮ অনুচ্ছেদকে ব্যাখ্যা করবেন? এর কোনো উত্তর দেননি তিনি। বলেছেন, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করবো না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বাচন কমিশন প্রথম সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা ফল প্রকাশ করে  সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের তিন দফার শর্ত লঙ্ঘন করেছে। দ্বিতীয় ভুল করলেন স্পিকার।

আবার  বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজাল। সরকারের ভেতরে থাকলেও প্রধান বিরোধী দল হিসেবেও ভূমিকা পালন করবে জাতীয় পার্টি।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমরা সরকারেও থাকব, বিরোধী দলেও থাকব। আমাদের অনেকেই সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকবেন।

এদিকে এ ঐকমত্যের সরকার নিয়ে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকলে যা হবে তাকে এক কথায় ‘আজব দেশের আজব কাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, বিরোধী দলে থাকার পাশাপাশি কোনো দল সরকারেও থাকছেÑ এমন উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। যদিও পাকিস্তানে এ ধরনের একটি কাণ্ড হয়েছিল।

তিনি বলেন, সরকার গঠনে সংবিধানে বিশেষভাবে কিছু বলার নেই। আমাদের দেশ এক দফা ঐকমত্যের সরকার দেখেছে। এবার নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার দেখারও সৌভাগ্য হয়েছে। হয়তো এরই ধারাবাহিকতায় এবার আমরা সরকারের বিরোধী দলে অংশীদারিত্বও দেখবো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দশম সংসদ নির্বাচনের আগেই সরকার একাদশ সংসদ নির্বাচনের ইঙ্গিত দেয়। এতে রাজনৈতিক সঙ্কটের বরফ গলবে, অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আশাব্যঞ্জক কিছু ছিল না। আবার দলের শীর্ষনেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিও হতাশাজনক। তবে সঙ্কট নিরসনে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে তারা মনে করেন। তাই সবার দৃষ্টি এখন সরকারের দিকে।

সঙ্কট নিরসনে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন কবে হবে? নাকি নতুন সরকারই যেকোনো প্রতিকূলতার মুখেও পাঁচ বছরই দেশ পরিচালনা করবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের পরে সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে কোনো সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা না দিয়ে একটি বার্তা দেশবাসীকে দিয়েছেন তা হলো ‘ধৈর্য ধরুন’।

তবে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ইতোমধ্যে বলেছেন, জামায়াতের শক্তিকে পুঁজি করেও সরকারকে দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাধ্য করার শক্তি সঞ্চয়ের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না বিএনপি। তাই তারা সহসা কোনো নির্বাচনের চিন্তা করছেন না।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য  মো. নাসিম বলেছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়ে জনগণ মহাজোটকে পাঁচ বছরের জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছে। আগামী পাঁচ বছর আমরা ক্ষমতায় থাকবো।বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী সোমবার বিএনপির উদ্দেশ্যে বলেছেন, সহিংসতা বন্ধ করুন, নইলে কঠিন শাস্তি।

অবশ্য সরকারীদলের এসব বক্তব্য-বিবৃতি বিএনপি আমলে নেবে তা কেউই মনে করেন না।

এদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একাধিক নেতা  বলেছেন, তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যতই নির্যাতন নেমে আসুক, আন্দোলন থামবে না। এরইমধ্যে দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জেল-জুলুম অগ্রাহ্য করেই তারা বড় আন্দোলন করে নতুন সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে থাকার স্বপ্ন পূরণ হতে দেবেন না বলে দলীয় নেতারা জানিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কোনোভাবেই সরকারের কোনো ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার ও অপকৌশল তীব্র গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারবে না। জনতার যৌক্তিক দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জনগণ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।

যদিও বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে দেশবাসীর কথা চিন্তা করে অবরোধ শুক্র ও শনিবার স্থগিত করা হয়েছে। এরপর থেকে আবারও চলবে অবরোধ কর্মসূচি।

বিশিষ্টজনদের মতে সরকার সংবিধানে সংরক্ষিত অধিকার থেকে বিরোধীদের বঞ্চিত করে, বিরোধীদলীয় নেতাকে কার্যত গৃহবন্দি রেখে একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছে সরকার।

তারা বলেছেন, আর বিলম্ব নয় অন্ধ রাজনৈতিক স্বার্থ ভুলে গিয়ে খাদের পাশে ঠেলে দেওয়া দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান। সংঘাত-সহিংসতার পথ পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে তারা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে এবার চূড়ান্ত  ফয়সালায় আসতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, নির্বাচনে যা হয়েছে তা সবাই দেখেছে। এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ নির্বাচনের পর দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, না পিছিয়ে যাবে? দেশ অগ্রসর হবে যদি রাজনৈতিক দলগুলো সমাধানে পৌঁছে এবং রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হয়।

তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা এবং দায়িত্ব দুটিই বেশি। আবার সরকার যদি ‘ইমার্জেন্সি’ দিয়ে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে দেশ নিশ্চিতভাবেই পিছিয়ে যাবে। এখন অপেক্ষা সরকার কোন পথে যায়, রাজনীতিবিদরা কোন ধরনের রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

আকবর আলি আরও বলেন, একটা নির্বাচন মানেই সঙ্কটের সমাধান নয়। সমঝোতা এবং আস্থার সংস্কৃতি রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা না পেলে সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানও হবে না।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, এ নির্বাচন নিয়ে যতই প্রশ্ন থাকুক না কেন, এ নির্বাচনের ফল বাতিলের সুযোগ নির্বাচন কমিশনের নেই। এখন একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সমঝোতা হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গলজনক। অন্যথায় অমঙ্গলের অশনিসংকেত। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ