মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা আখেরি মোনাজাতে
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, টঙ্গীঃ ইহলোকের মঙ্গল, পরলোকের ক্ষমা, দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তি কামনার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে। এরপর চারদিন বিরতি দিয়ে আগামী শুক্রবার থেকে শুরু হবে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব।
রোববার বেলা সড়ে ১২টা ৫৪ মিনিটে আখেরি মোনাজাত শুরু হয়। শেষ হয় ১টা ১৮ মিনিটে। মোনাজাত পরিচালনা করেন দিল্লীর মাওলানা যুবায়রুল হাসান আখেরি মোনাজাত। এর আগে শুক্রবার আম বয়ানের মধ্য দিয়ে ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়।
মাঠ, রাজপথ, ঘরবাড়ির ছাদ, তুরাগের দুই তীর, কিনারে ভিড়ে থাকা নৌকা, পথে দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে কাতরস্বরে মহান আল্লাহর কাছে মিনতি করে প্রার্থনা করেছেন ধর্মপ্রাণ অগণিত মানুষ। এ সময় কারও দুই চোখ ছিল মুদিত, কারও দৃষ্টি ছিল সুদূরে প্রসারিত। আর থরথর কম্পমান দুই ঠোঁটে মৃদু স্বরে উচ্চারিত হয়েছে ‘আমিন আমিন’ ধ্বনি। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহ ভিক্ষা করছিলেন তারা। ক্ষমালাভের আশায় লাখো মানুষের সঙ্গে একত্রে হাত তুলতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন তারা।
আখেরি মোনাজাতে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, মুসলিম বিশ্বের কুটনীতিকগণ অংশ নিয়েছেন।
তবে প্রধানমন্ত্রী ইজতেমা এলাকায় না এসে গণবভনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মোনাজাতে অংশ নিতে নেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মূল মঞ্চের কাছে গিয়ে মোনাজাতে শরিক হন বলে জানা গেছে।
এটলাস কোম্পানির ছাদে বিশেষ মঞ্চে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
মন্ত্রী পরিষদ সদস্য ছাড়াও সংসদ সদস্য এবং ভিআইপিদের জন্য ইজতেমা মাঠ এবং আশপাশের বিভিন্ন ভবনের ছাদে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আখেরি মোনাজাতে ইজতেমাস্থল টঙ্গী শহর ও এর আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বন্ধ হয়ে যায় মহাসড়কে যান চলাচল। ভোর ৬টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী এবং ধউর সেতু থেকে আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রগতি সরণী পর্যন্ত মহাসড়ক বন্ধ থাকে। মূলত জরুরি গাড়ি যাতায়াতের জন্য ও যানজট এড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকে।
আখেরি মোনাজাতের প্রস্তুতি: রোববার আখেরি মোনাজাতের আগেরদিন মুসল্লিদের ঢলের কারণে মূল প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে অনেকে নিজ উদ্যোগেই প্যান্ডেলের বাইরে পলিথিন, চট, গাড়ির সিট, পলিথিন, কাগজ এমনকি কাপড়ের সামিয়ানা টানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন।
অতিরিক্ত মাইক সংযোগ: বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত প্রচারের জন্য গণ যোগাযোগ অধিদপ্তর ও গাজীপুর জেলা তথ্য অফিস বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে গণ যোগাযোগ অধিদপ্তর ইজতেমা ময়দান থেকে আব্দুল্লাহপুর ও বিমানবন্দর রোড পর্যন্ত এবং গাজীপুর জেলা তথ্য অফিস ইজতেমা ময়দান থেকে চেরাগআলী, টঙ্গী রেল স্টেশন, স্টেশন রোড ও আশপাশের অলিগলি পর্যাপ্ত মাইক সংযোগের ব্যবস্থা করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা তথ্য অফিসার মো. আবু সায়েম হোসেন।
বয়ান: বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিনে শনিবার বাদ ফযর বয়ান করেন পাকিস্থান থেকে আগত তাবলিগের মুরুব্বী হাজী আব্দুল ওহাব, বাদ জোহর বয়ান করেন পাকিস্থানের মাওলানা জমশের, বাদ আসর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা জুবায়েরুল হাসান এবং বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের আহম্মেদ লার্ট।
তাবলিগ জামাতের মুরব্বিরা ইজতেমার সুবিশাল ময়দানে সমবেত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশ্যে তাবলিগের ছয় নম্বর যথা কালিমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিয়ে নিয়ত এবং তাবলিগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন। বয়ানে তাবলিগ মুরব্বিরা বলেন, যতদিন দ্বীন থাকবে, তত দিন দুনিয়া থাকবে। আর দ্বীন টিকে থাকবে দাওয়াতের মাধ্যমে। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করে গেছেন। ফেরাউনের কাছেও দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে আল্লাহ্ হযরত মুসাকে (আ.)পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ যাল্লে জালালুহু নবী-রাসুলদেরকে তাদের নিজের পরিবার ও বিভিন্ন গোত্রের মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফাকে (সা:)সারা দুনিয়ায় দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। আজ তিনি নেই। এ কাজের জিম্মাদারি এখন তার উম্মতের ওপর।
বয়ানে আরও বলা হয়, ‘জুম্মারদিন, একটি পবিত্র দিন। সবচেয়ে উত্তম দিন হলো জুম্মার দিন। এটি হলো সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত দিন। এটি দু’ঈদের চেয়েও ফজিলতপূর্ণ। এদিনে হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়। এদিনই দুনিয়া ধ্বংস হবে। এদিনে আল্লাহর কাছে যা চাইবে, আল্লাহ তা তাকে দেবেন। জুমা’র নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে গোসল-ওজু করে মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর থেকে বান্দার নেকী লেখা হয়। আমরা যা করবো আল্লাহকে রাজি করার জন্য করবো। আল্লাহ পাকের হুকুম মতো আমরা যেন সারা জীবন চলতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ও সারা দুনিয়ায় মানুষের মাঝে দীন কায়েম করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে হবে।
বয়ানের তাৎক্ষণিক অনুবাদ: বিশ্বইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের ১৫-২০ জন শুরা সদস্য ও বুজর্গ বয়ান করছেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ হচ্ছে। বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন করে মুরুব্বি মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শুনান। মূল বক্তা বয়ানের একটি নির্দিষ্ট অংশ শেষ করার পর অনুবাদের জন্য বিরতি দেন। অনুবাদ শেষ হলে তিনি আবার বয়ান শুরু করেন। এভাবেই ইজতেমা ময়দানে তাবলিগ জামাতের মুরব্বিদের বয়ান চলে।
যৌতুকবিহীন গণবিবাহ: শনিবার বাদ আসর ইজতেমার মূল মঞ্চে কনের অভিভাবক ও বরের উপস্থিতিতে যৌতুকবিহীন গণবিয়ে পড়ানো হয়। বিয়ে শেষে মঞ্চে খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত শতাধিক বর ও কনের বিয়ে সম্পন্ন হয়। ইজতেমা শেষে বর ও কনের পিতা জামাতবন্ধী হয়ে তিন চিল্লায় (১২০দিন) তাবলিগের কাজে বের হবেন।
চিকিৎসা সেবা: ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের অনেকে আকষ্মিক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইবনে সিনা ও হামদর্দসহ ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র এলাকা ঘুরে দেখা গেছে মুসল্লিরা দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করছেন। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ইবনে সিনা ও হামদর্দ ক্যাম্পের সামনে সবচে বেশি দীর্ঘ লাইন লক্ষ্য করা গেছে। মুসল্লিদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য ময়দানের আশপাশে ও মন্নু নগর এলাকায় বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি পরিষদ, হোমিওপ্যাথি অনুশীলন, র্যাবের ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্প, গাজীপুর সিভিল সার্জন অফিস, হামদর্দ ওয়াকফ, ইবনে সিনা, ইন্টার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, অ্যাপেক্স বাংলাদেশ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম,পাকিজাগ্রুপ, টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ি কল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধশত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন।
ইজতেমায় আরও ৩ জনের মৃত্যু: বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে একজন বিদেশীসহ আরও ৩ জন মুসল্লি মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) শুক্রবার রাতে ১ জন, শনিবার ভোরে ১ জন ও সকালে একজন বিদেশী মুসল্লি মারা যান। নিহতরা হলেন, কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার পাকুরিয়া গ্রামের মোঃ জিহাদ আলী (৫৩)।
তিনি শনিবার ভোর সাড়ে ৪টায় ইজতেমা ময়দানে আকষ্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। সকাল ৮টায় বিদেশী টেন্টে মারা যান মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেনের নাগরিক আহমেদ আবদুল্লাহ হারুন। তার পিতার নাম আহমেদ আবদুল্লাহ বাউ। তিনি আকষ্মিক বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাকে চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। নিহত অন্য জনের (৫০) পরিচয় জানা যায়নি। রাত দেড়টায় ময়দানের ৮ নম্বর টয়লেট ভবনের সামনে থেকে পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে তাবলীগ জামাতের লাশের জিম্মাদারদের কাছে হস্তান্তর করে। অজ্ঞাত পরিচয় এই ব্যক্তির লাশ ইজতেমা ময়দানে লাশের গোসলখানায় রাখা হয়। তাবলীগ জামাতের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
পানি সরবরাহ: বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীতে ১৯৬৫ সালে প্রথম শুরু হয়। সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নলকূপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের কিছু ব্যবস্থা করলেও স্যানিটেশনের উন্নয়নে ইতিপূর্বে তেমন কিছু করা হয়নি।
দিনদিন ইজতেমায় দেশী বিদেশী মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় ২০০৭/০৮ অর্থ বছর থেকে সরকারী অর্থায়নে ইজতেমা মাঠে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বিশ্ব ইজতেমা মাঠে ১৩টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে দৈনিক ৭০ লাখ গ্যালন পানি সাড়ে ১২ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন অজুখানা, টয়লেট, গোসল খানায় সার্বক্ষণিক সরবরাহ করছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহ: ইজতেমা ময়দানে স্থাপিত ডেসকোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা যায়, ইজতেমা ময়দানে পিক-আওয়ারে বর্তমানে আড়াই মেগাওয়ার্ট বিদ্যুতের প্রয়োজন হচ্ছে। তিনটি ফিডার ও ১১টি ট্রান্সফর্মারের মাধ্যমে ইজতেমা ময়দানে নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।