নিরুপায় এরশাদ

সিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি,ঢাকাঃ বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অসহায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাকে কখনো এতো বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি।৯০ সালে পতনের পর কারারুদ্ধ হয়েও নিজেকে এত অসহায়বোধ করেননি। দলের ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ঘরে বাইরে কেউ তার কথা শুনছেন না। সরকারের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে দলের ওপর। আর তা কার্যকর করছে দলের সুবিধাবাদী নেতারা। অবাধ্য হয়ে উঠছেন স্ত্রী রওশনও।কখনো কখনো এরশাদ-রওশন মুখোমুখি। দলের অস্তিত্ব ও জীবনের অস্তায়মান দিনে মামলার ভয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রশ্নেও তিনি  চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় পাটি নেতারা।

জাতীয় পাটি সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণায় এরশাদের নির্দেশে তার অনুগতরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন।অন্যদিকে সুবিধাভোগীরা নির্বাচনে যান। আবেদন করলেও  এরশাদসহ জাপার কারও কারও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার অনুমোদন করেনি নির্বাচন কমিশন।এ পরিস্থিতিতে এরশাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে এমপি নির্বাচিত করা হয়। তিনি নির্বাচিতদের শপথ না নেয়ার নির্দেশ দেন এবং নিজে শপথ না নেয়ার ঘোষণা দেন। তার নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচিতরা শপথ নেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেও শপথ নেন এবং সংসদ অধিবেশনেও যোগ দেন। স্পিকারের সামনে সেদিন তিনি শপথের জন্য হাজির হয়েছিলেন বিমর্ষ চেহারায়। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কাউকে সেখানে উপস্থিত রাখা হয়নি। খুব গোপনে হয়েছিল সে শপথ। তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। এমনকি সংবাদকর্মীদের সঙ্গে নয়।

নতুন সরকার গঠনের পর তাকে করা হলো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। দেয়া হলো মন্ত্রীর মর্যাদা। এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়ায় জানতে চাইলে দূত হওয়ার খবর তিনি জানতেন না বলে জানান। মিডিয়ার মাধ্যমে নাকি শুনেছেন।  তিনি  জানালেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দূতের দায়িত্বপালন তার জন্য সম্মানজনক নয়। কিন্তু এখানেও তার ইচ্ছার পরাজয়। তিনি কয়দিন পরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দূত হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সম্মতি দেন। জাতীয় পতাকা শোভিত গাড়ি নিয়ে আদালতে যান। এভাবে একের পর এক অসহায় আত্মসমর্পণ একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি এরশাদের।

সূত্রমতে, এখন নিজ ঘরেই এরশাদ মারাত্মকভাবে নিগৃহীত। বিগত বিএনপি সরকারের তোপের মুখে তিনি  বিদিশাকে তালাক দিতে বাধ্যহন। ৬১ বছরের দাম্পত্যজীবনের অংশীদার রওশনও তার কাছে থাকছে না। এরশাদ ও রওশন- দু’জনই  বুধবার সংসদে পাশাপাশি আসনে বসেছিলেন। সংসদ অধিবেশন চলার পুরো সময়, প্রায় তিন ঘণ্টা তারা ছিলেন পাশাপাশি আসনে। তবে একটি বারের জন্যও দু’জনকে কথা বলতে দেখা যায়নি। এমনকি অধিবেশনের বিরতির সময় লবিতেও তারা বসেছিলেন কয়েক হাত দূরত্বে। সেখানেও তাদের কথা হয়নি।এ পরিস্থিতিতে সাথী নামে এক কলেজ পড়ুয়া তরুণির সঙ্গে লিভ টুগেদারের গুঞ্জন উঠলেও সমালোচনা ভয়ে ঐ তরুণীকেও নাকি তিনি কাছে রাখতে পারেননি। তার ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত নিসঙ্গ। সেখানে আছে শূন্যতা আর হাহাকার।

ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর এরশাদ কখনোই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি বলে মনে করেন জাতীয় পার্টি কোনো কোনো নেতা।  নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গৃহীত সিদ্ধান্তে তার দলীয় অস্তিত্ব হুমকির মুখে। নির্বাচনে আগে কাজী জাফরের নেতৃত্বে পাটি বিভক্ত হয়।  এখনো কেউ কেউ পার্টি ভাঙ্গতে  তৎপর। অনেকে দল ছেড়ে চলে গেছেন। সর্বশেষ এরশাদকে ত্যাগ করলেন তার দলের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য আহসান হাবিব লিঙ্কন। অনেকে পদত্যাগের পথ খুঁজছেন। এরশাদকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। এরশাদ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দেখছেন তার অধোগামিতা, দেখছেন তার তরান্বিত পতন।

নিজের অসহায়ত্ব সম্পর্কে এরশাদ বলেছিলেন, আপনারা  অনেকে মনে করেন এরশাদ সাব সকালে এক কথা বলে। বিকেলে আর এক কথা বলে। এ কথা কিছুটা ঠিক। আমি কেন এমন করি সেটা আপনাদের বুঝতে হবে। আমি এক শৃঙ্খলিত রাজনীতিবিদ। পদত্যাগের পর আমি কখনো মুক্ত রাজনীতি করতে পারিনি। আমার বিরুদ্ধে ৭৪টি মামলা। ৯০ সালের পর থেকে আমি কখনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশে ঘটলো আরেকটি অঘটন। রাতের আঁধারে হঠাৎ করেই র‌্যাব তাকে নিয়ে যায় সামরিক হাসপাতালে। দলের বিশ্বস্ত লোকজন, আত্মীয় স্বজন কিংবা ভাইবোন কেউই জানলো না তার অসুস্থতার খবর। জানলো কেবল রাষ্ট্রযন্ত্র।  তাই সবকিছু হলো সরকার ও জাপার কুচক্রীদের যৌথ ব্যবস্থাপনায়। সিএমএইচে তার অবস্থানকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে ছিল পরস্পরবিরোধী বক্তব্য। দলের সরকারপন্থী নেতাদের মতে তিনি ছিলেন চিকিৎসাধীন। জিএম কাদেরের মতে এরশাদ ছিলেন আটক। আবার এ বিষয়ে রওশন কখনোই মুখ খুলেননি।

স্ত্রী রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতা হওয়ার পর দলীয় মন্ত্রী ও এমপিরা এখন রওশনের পাশে।

এদিকে নির্বাচনের আগে এরশাদের বর্জনের ঘোষণা দেয়ার পর যেসব প্রার্থী সরে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারাও ক্ষোভ আর অভিমান নিয়ে এরশাদ থেকে দূরে। জীবনের এই চরম দুর্দিনে এরশাদের সামনে হাজির হয়েছে আরেক পরীক্ষা। মঞ্জুর হত্যা মামলার খড়্গ তার মাথার ওপর। মামলার রায় ১০ ফেব্রুয়ারি। এ রায় নিয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন এরশাদ। বুধবার আদালতে এরশাদকে বেশ বিচলিত দেখা গেছে। তার চেহারা ছিল বিবর্ণ।

এরশাদের অনুগত নেতাকর্মীরাই বলছেন, এরশাদ চরম দুঃসময় পার করছেন। দলে যেমন তার নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনেও তিনি আস্থাহীন।

দলের ওপর এরশাদের কতৃত্ব এবং সরকারের সঙ্গে এরশাদের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমদ মিলন এবিসি নিউজ বিডিকে বলেন, এরশাদ দুঃসময় পার করছেন। কেউ কেউ তাকে মানছে না। সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ