গড়ে প্রতিদিন একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড

Odhikar আধিকারসিনিয়র রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ দেশে প্রতিদিন গড়ে একজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে তথ্য প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’।

শনিবার সংস্থাটির মাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।

গত পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সংঘটিত বিচারবহির্র্র্ভূত হত্যাকাণ্ডের তথ্য দেওয়া হয়েছে এ প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, এ সময়ে প্রতিদিন গড়ে একজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পর যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়।

অধিকার-এর তথ্যমতে, ৫ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন বিএনপি, সাতজন জামায়াতের কর্মী ও একজন কথিত অপরাধী বলে জানা গেছে। এছাড়া, পয়লা জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৩৯ জন। সংস্থার হিসাব মতে, ২৭ জানুয়ারি ভোরে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সহ-সভাপতি আজহারুল ইসলাম (২৮) যৌথবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। ২৬ জানুয়ারি আজহারুল ইসলামকে ঘোনা এলাকার একটি চিংড়িঘের থেকে আটক করে যৌথবাহিনী। আজহারুল ইসলামের স্ত্রী কামিনী পারভিন চম্পা জানান, তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার শাশুড়ি ও শিশু সন্তান নিয়ে সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত তালা থানার গেটে দাঁড়িয়েছিলেন। রাত আনুমানিক ১২টায় তাদের থানার গেট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর ৭-৮টি পুলিশের গাড়ি থানার সামনে আসে এবং তার স্বামীকে নিয়ে চলে যায়। সকালে তারা জানতে পারেন ভোর রাতে মাগুড়া খেয়াঘাট এলাকায় তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

অধিকার-এর তথ্য মতে,নীলফামারী জেলা সদরের রামগঞ্জ বাজারে তৎকালীন এমপি (বর্তমান সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী) আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলার ঘটনার আসামি ছাত্রদল নেতা আতিকুর রহমানের (২৬)-এর লাশ গত ২০ জানুয়ারি নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার বাইপাস সড়কের নাড়িয়াডাঙ্গা এলাকা থেকে পুলিশ উদ্ধার করে। আতিকুরের বড় ভাই আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরের হামলার ঘটনার পর থেকে আতিকুর পলাতক ছিল। ১৩ জানুয়ারি রাতে টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলা সদরের শাফিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের একটি বাড়ি থেকে আতিকুর ও একই গ্রামের মহিদুল (২৬)-কে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা গ্রেফতার করে বলে জানতে পারেন। কিন্তু থানা পুলিশসহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়েও তারা আতিকুরের অবস্থান জানতে পারেননি।’এর ২ দিন আগে গত ১৮ জানুয়ারি আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলার অন্যতম আসামি নীলফামারী জেলার লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়ন বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর লাশ উদ্ধার করে নীলফামারী থানা পুলিশ। গোলাম রাব্বানীর আত্মীয়রা অভিযোগ করেন, র‌্যাব রব্বানীকে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় এবং কয়েক দিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। গত ১৯ জানুয়ারি দিবাগত রাতে মেহেরপুর জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি তারিক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম (৩৫) যৌথবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। এদিন আনুমানিক বিকাল ৩টায় মেহেরপুর শহরের ইসলামী ব্যাংক ভবন থেকে গোয়েন্দা পুলিশ ও সদর থানা পুলিশের একটি দল তাকে আটক করে।

অধিকার-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারি মাসে ৩৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডগুলো র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি এবং যৌথবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৪ ডিসেম্বর নীলফামারীতে তৎকালীন এমপি আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহর রামগঞ্জ ব্রিজের সামনে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের কেটে দেওয়া রাস্তায় আটকে যায়। এ সময় পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত-শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় চারজন আওয়ামী লীগের কর্মী ও একজন জামায়াতের কর্মী নিহত হন।

এদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ফলে নিহত ৩৯ জনের মধ্যে ২০ জন ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে র‌্যাব কর্তৃক দু’জন, পুলিশ কর্তৃক ১০ জন এবং যৌথবাহিনী কর্তৃক আটজন ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিহত ৩৯ জনের মধ্যে ১৮ জন গুলিতে নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে র‌্যাবের হাতে দু’জন, পুলিশের হাতে ১২ জন, বিজিবি’র হাতে একজন এবং যৌথবাহিনীর গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিহত ৩৯ জনের মধ্যে বিজিবি একজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। নিহত ৩৯ জনের মধ্যে ১১ জন বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের সদস্য, ১৫ জন জামায়াত ও শিবির সদস্য, একজন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সদস্য, একজন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) সদস্য, ১০ জন কথিত অপরাধী বলে জানা গেছে এবং একজনের পেশা জানা যায়নি।

এদিকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরে অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই দিন ১০ম জাতীয় সংসদের বিতর্কিত নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ তাদের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনকৃত বেশির ভাগ দলই অংশগ্রহণ করেনি। বিরোধী জোট এ নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দেয়। এতে করে নির্বাচনের আগেই নজিরবিহীনভাবে ১৫৩টি আসনে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও  আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থকরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এরপর ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৪৭টি আসনে। এদিকে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার কারণে মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬১ জন ভোটারের মধ্যে ৪ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার ৩৯ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগের কোন সুযোগ পাননি। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে ৪০.৫৬ ভাগ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকা ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা আরও অনেক কম শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানায়। ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং এলায়েন্স (ফেমা) নির্বাচনের দিন বেলা ২টা পর্যন্ত ১০ ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণের খবর দেয় ও দিনের শেষে তারা ১৪ ভাগ ভোটারের ভোট দেয়ার কথা বলে। ইংরেজি দৈনিক নিউএজ ১০ থেকে ১২ ভাগ এবং দি ডেইলি স্টার ২০ ভাগ ভোট পড়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করে। এদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করেছেন। নির্বাচন চলাকালে ৩১টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করেন এবং নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে নির্বাচন বর্জন করেন। এছাড়া ৩৮টি কেন্দ্রে কোনো ভোট না পড়ার রেকর্ডও সৃষ্টি হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে নামমাত্র ভোটার ভোট দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় জোটের নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা এবং নির্বাচনের দিন হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করায় বিভিন্ন কেন্দ্রে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। জানুয়ারি মাসে নির্বাচন নিয়ে ৩৯ জন নিহত হয়েছেন। যারা হয় পুলিশ, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও ১৮ দলীয় জোট সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অথবা পেট্রল বোমার আক্রমণে নিহত হয়েছেন। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন না হওয়ায় অধিকারও সরাসরি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু বিভিন্ন এলাকায় অধিকার-এর মানবাধিকার কর্মী ও  গণমাধ্যমের কর্মীদের মাধ্যমে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন পরিস্থিতির ওপর নজর রেখে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের এসব তথ্য সংগ্রহ করে অধিকার।

সংখ্যালঘু নাগরিকদের ওপর হামলা: নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচনের পরেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে এবং তা এখনও হচ্ছে। অধিকার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে লক্ষ্য করছে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর প্রতিটি নির্বাচনের পর হামলা চালানোর ঘটনা একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে আক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার জন্য মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন।

অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৬ জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাব কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে ছাপাখানা সিলগালা করে দিয়েছে পুলিশ। ‘সাতক্ষীরায় যৌথ বাহিনীর অপারেশনে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা’ শিরোনামে ছাপা হওয়া প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ওয়ারী থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত -২০১৩) ও দণ্ডবিধিতে মামলা দায়ের করা হয়। এর আগে সরকার বিরোধীদলীয় ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া- চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি এবং দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এরপর সর্বশেষ ঘটনায় ইনকিলাবের সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় সরকার। অধিকার মনে করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯ ও ২০১৩) এর মাধ্যমে মত প্রকাশ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ব্যাপক সুযোগ হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নসাৎ করছে। এ আইনের মাধ্যমে সরকার সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও ভিন্নমতালম্বী নাগরিকদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ২৯ জন নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করে। ২০১৪ সালেও এ ধারা অব্যাহত আছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে  সমঝোতা এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে সীমান্তের কাছে বাংলাদেশীদের দেখা মাত্র গুলি করে হত্যা করছে ও অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাংলাদেশী নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ।

এতে বলা হয়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে দেশে ১৬ ব্যক্তি গণপিটুনিতে মারা গেছেন।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ