চোরের উপর বাটপারী
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ চোরের উপর বাটপারী করতে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সদস্যসহ ৫ জন এখন র্যাবের খাচায় বন্দি। শুক্রবার র্যাবের স্বাসরুদ্ধকর অভিযানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এবিষয়ে শনিবার বিকালে র্যাব সদর দফতরে গ্রেফতার হওয়াদের সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে এসেছে নানান তথ্য। যেসব তথ্যয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সদস্যদের ভয়ানক অপরাধ বেরিয়ে আসে।
যশোর থেকে অবৈধ সোনা ও ডলারের একটি চালান পাচারের জন্য তারা ঢাকায় আসে।চোরাকারবারী দলের দুই সদস্য ওই চালানটি নিয়ে আসলেও তাদেরই একজন আবার চালানটি পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়। অবৈধ ডলার ও সোনার চালানসহ চোরাকারবারী দলের সদস্যকে আটকের বিষয়টি গোপন রেখে তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে পুলিশের এক এএসআই। সঙ্গে ছিল সাবেক এক সেনা সদস্য ও দুই সোর্সসহ কয়েকজন। যারা নিজেদের পুলিশেল সিভিল টিম বলে পরিচয় দেয়। উদ্দেশ্য ছিল পুরো চালানটি তারা নিজেদের মধ্যে ভাগভাটোয়ার করবে। চোরের উপর বাটপারি করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যদের হাতে আটক হয়ে আম ছালা দুটোই হারালো ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
দীর্ঘদিন ধরে এমন অপকর্ম করে আসা সাভার থানার এ এসআই ফাইজুলের নামে ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আটক হয় সাবেক সেনা সদস্য মো. রেজাউল, দুই সোর্স সুজন ও মিরান খান। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি দলের হাতে আটক হয় তারা।তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা, পুলিশের রিভালভারসহ আরো একটি পিস্তল, হ্যান্ডক্যাপ, ছুড়ি ও মোবাইল উদ্ধার হয়।
অভিযানের সময় পালিয়ে যাওয়া সোর্স ও চোরকারবারী দলের সদস্য খোকন ওরফে সাজ্জাদসহ চক্রের বাকি সদস্যদের আটকের জন্য অভিযান চালাতে গিয়ে মারাত্মক আহত হন র্যাব ৪ এর সহকারী পরিচালক কাপ্টেন নাহিদ।
শুক্রবার গভীর রাতে আশুলিয়া এলাকায় যশোর থেকে সোনা ও ডলারের একটি চালান আসে ঢাকায়।পাচারের সময় চালানসহ পাচারকারী দলের এক সদস্যকে গাড়ি থেকে নামিয়ে থানায় না নিয়ে অন্যত্র নেওয়ার সময় র্যাবের হাতে আটক হন সাভার থানার এএসআই ফাইজুল ইসলাম।সঙ্গে আটক করা সেনাবাহিনীর সাবেক এক সদস্য ও দুই সোর্সকে।পরে তাদের দেয়া তথ্যে উদ্ধার করে আটক করা হয় চালান বহনকারী চোরাকারবারী দলের এক সদস্য ও চালানটির মূল মালিক সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যানকে। এ বিষয়ে র্যাবের কাছে গোপন তথ্য ছিল একটি অবৈধ চালানসহ পাচারকারী দলের এক সদস্যকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ করা হতে পারে।
পুরো ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, চোরাকারবারী দলের মূল হোতা সবুর চেয়ারম্যান অবৈধ ডলার ও সোনার একটি চালান ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার দলের সদস্য সামছুল হক ও খোকনকে ঢাকায় পাঠায়। তারা যশোর থেকে ঈগল পরিবহনে রওনা দিলেও পথে গাড়ি পরিবর্তন করে অন্য একটি গাড়িতে সাভার পৌঁছে। কথা ছিল সামছুল হক ও খোকন চালানটি পৌঁছে দিবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। চালানটি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও ছিল খোকনের উপর। কিন্তু সাভার পৌঁছার পর সামছুল হককে ফেলে রেখে চম্পট দেয় খোকন।
ভিন্ন কৌশলে ডলার ও সোনার এ চোরাচালানটি পৌঁছে দেওয়ার নামে আত্মসাৎ করার জন্য পরিকল্পনা করে খোকন। পরিকল্পনা মোতাবেক সাভার থানার এ এসআই ফায়জুলকে বিষয়টি জানায়। এ এসআই ফায়জুল বিষয়টি জানলেও থানায় অবগত না জানিয়ে পেশাদার অপরাধী চক্রের কয়েক সদস্য নিয়ে সিভিল পোশাকে সামছুল হককে আটক করার জন্য আসে। খোকনের মাধ্যমে সামছুল হককে চিহ্নিত করার পর তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে চালানটি হাতিয়ে নেয়।
তিনি আরো জানান, এ এসআই ফায়জুলের মূল লক্ষ ছিল সামছুলকে অন্যত্র ধরে নিয়ে গিয়ে তার কাছ থেকে ডলার ও সোনার চালানটি ভাগভাটোয়ারা করবে। সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে ডলার ও সোনা নিয়ে চোরাকারবারী দলের সদস্য সামছুল হক আশুলিয়ায় রওনা দিলে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে প্রথমে চালানটি হাতিয়ে নেয়া হয়। ওই সময় এস আই ফাইজুল হকের সঙ্গে থাকা বাকিরা নিজেদের পুলিশের সদস্য পরিচয় দেয়। পুলিশ পরিচয়ে সামছুল হক গ্রুপের কয়েকজন দিয়ে অন্যত্র নিয়ে যায়। ঘটনার সময় র্যাব ৪ এর একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছলে এএসআই ফাইজুল নিজেকে সাভার থানার এএসআই পরিচয় দিলেও বাকিরা নিজেদের সঠিক কোনো পরিচয় দিতে পারেনি। র্যাব এ এসআই ফাইজুলকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি সামছুল হককে আটকের ব্যাপারে কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। পরে এএসআই ফায়জুল হক, তার সহযোগী সেনা বাহিনীর সাবেক সদস্য মো: রেজাউল হক, পুলিশের সোর্স সুজন শেখ, ও মিরান খানকে আটক করে। ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে পাচারকারী দলের সদস্য খোকন ওরফে সাজ্জাদসহ ৪ থেকে ৫ জন চালানটি নিয়ে পালিয়ে যায়।
র্যাব ৪ এর ক্যাপ্টেন নাহিদের নেতৃত্বে আরেকটি টিম তাদের পিছু নেয়। ভোর রাতের দিকে স্থানীয় লোকজন জানায় র্যাবের একজন সদস্য আহত হয়ে আশুলিয়া এলাকায় পড়ে আছে। পরে র্যাবের আরেকটি টিম গিয়ে দেখে ক্যাপ্টেন নাহিদ মারাত্মক জখম হয়ে পড়ে আছে। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ ও পরে সাভার সিএমএইচ ও শেষে ঢাকায় আনা হয়। বর্তমানে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মূলত পাচারকারী চলের সদস্য হলেও খোকন পুলিশের সোর্স হিসেবেও কাজ করে। বিভিন্ন সময়ে খোকন বিভিন্ন অবৈধ মালামাল এভাবে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়।পরে সেটির ভাগ পায় খোকন। আর পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে পাচারকারীদের ধরে নিয়ে গোপন জায়গায় নিয়ে যায়। পরে তাদের কাছ থেকে অবৈধ পন্য কেড়ে নিয়ে পাচারকারীদের ছেড়ে দেয়। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে এ এসআই ফায়জুলসহ সাভার থানা পুলিশের অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা নানা অপকর্ম করে আসছে।
আটক সাবেক সেনা সদস্য রেজাউল জানান, সে সাভার ক্যান্টনমেন্টে চাকরি করতো। সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল পদে থাকার পর ২০১২ সালের দিকে চাকরি ছেড়ে দেয়। এর পর থেকে সে সাভার এলাকায় থাকে। পাচারকারী দলের সদস্য খোকন ওরফে সাজ্জাদের সঙ্গে তার কয়েকদিন আগে পরিচয় হয়।শুক্রবার একটি চালান ঢাকায় আসবে বলে খোকন তাকে তথ্য দেয়। খোকনই তাকে বলে সে তার সঙ্গী সামছুলকে চিনিয়ে দিবে এবং তার কাছে ডলার ও সোনার একটি চালান রয়েছে। যা মেরে দেওয়া সম্ভব। বিষয়টি নিয়ে সে এএসআই ফাইজুলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ফাইজুলই পরিকল্পনা করে কিভাবে তারা চালানটি ধরবে। এএসআই ফাইজুল সিভিল টিমে সরকারি রিভালভার ও হ্যান্ডক্যাপ নিয়ে সাভার বাসস্টান্ডের কাছে পৌঁছে এবং সোর্স সুজন শেখ ও মিরান খানকে সঙ্গে নিয়ে আসে। এএসআই ফাইজুলের নেতৃত্বে তারা চোরাকারবারী চলের সদস্য সামছুল হককে ধরে নিয়ে তার কাছ থেকে সোনা ও ডলারের চালানটি নিয়ে যায়।
সোর্স সুজন জানায়, তাকে এএসআই ফাইজুল খবর দিয়ে আনে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয় আশুলিয়া থানার এক এসআইয়ের সঙ্গে। কিন্তু বিপদ হতে পারে ভেবে তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি ওই এসআই।
তাদের পরিকল্পনা ছিল সামছুল হককে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার কাছ থেকে ডলার ও সোনার চালানটি রেখে দিয়ে পরে সামছুল হককে ছেড়ে দিবে অথবা গায়েব করে ফেলবে যাতে কোনো প্রমাণ না থাকে।
সুজন আরো জানায়, সে এক সময় পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতো। মাঝে একবার কাজ ছেড়ে দেওয়ায় সাভার থানার কাউসার নামে এক এসআই তাকে মাদক মামলায় ফাসিয়ে দিয়ে জেলে পাঠায়। জেল খেটে কয়েকদিন আগে ছাড়া পায়।
আরেক সোর্স মিরান খান বলেন, পুলিশ পরিচয়ে যশোর থেকে ডলার ও সোনার চালান আসছে। চালানসহ এর বাহককে ধরে নিয়ে চালানটি রেখে দিতে হবে। তবে পুরো বিষয়টি থাকবে গোপন। কারণ বিসয়টি থানায় জানানো যাবে না। তবে এ কাজের জন্য আশুলিয়া থানার এসআই মোস্তাফিজকেও প্রস্তাব দেয়া হয়। পরে মোস্তাফিজ বিষয়টি ওসিকে জানিয়ে করার জন্য বলে। কিন্তু ওসির কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় মোস্তাফিজ তাদের সঙ্গে আসেনি।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে ও চোরাকারবারী দলের কিছু সদস্যদের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে সাভার এলাকায় অবৈধ চোরাচালান আটক হয় পুলিশের হাতে। পুলিশের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা অপরাধী চক্রের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে চোরকারবীদের আটকের পর তাদের থানায় না নিয়ে নিজস্ব গোপন স্থানে নিয়ে চোরাচালানের মালামাল রেখে দেয়। পরে এগুলো ভাগভাটোয়ারা করেন। এসব পুলিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপহরণ করে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।