স্যানিটারি ইন্সপেক্টর স্বল্পতায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ স্বাস্থ্য রক্ষা ও খাদ্যে ভেজালরোধে ব্রিটিশ আমল থেকে স্যানিটারি ইন্সপেক্টররা দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত নয় দশকে দেশের জনসংখ্যা কয়েক গুণ বাড়লেও বাড়েনি এ ধরনের পরিদর্শকের সংখ্যা। এ পদে নতুন জনবল কাঠামোও তৈরি করা হয়নি। যারা কর্মরত, তারাও প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকেন। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকছে মানুষ। বিশেষত গ্রামের মানুষ ভেজাল খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে জনস্বাস্থ্য এবং এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীলতার প্রশ্নটি থেকে যাচ্ছে ভীষণ উপেক্ষিত।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে ৪৬৫টি স্যানিটারি পরিদর্শকের পদ রয়েছে। পদগুলো ১৯২৭ সালে সৃষ্টি হয়। দেশে উপজেলার সংখ্যাও ৪৬৫। গত ৮৭ বছরে স্বাস্থ্য পরিদর্শকের কোনো নতুন পদ সৃষ্টি হয়নি। দেশের প্রতিটি উপজেলায় গড়ে প্রায় চার লাখ লোকের বাস। অর্থাৎ প্রতি চার লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন স্যানিটারি পরির্দশক রয়েছেন; যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। আবার যারা কর্মরত, উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ তারা করছেন না।
স্যানিটারি পরিদর্শকের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, জনসাধারণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ, প্রিমিসেস লাইসেন্স প্রদান, জনস্বাস্থ্য আইন প্রয়োগের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণ, পশু জবাই আইন প্রয়োগ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে স্যানিটারি পরিদর্শক উপজেলায় জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো অবগত থাকবেন। বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করবেন। সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব রোধে হাট-বাজার, কসাইখানা, মেলার স্থান ও শিল্প প্রদর্শনী, ধর্মীয় ও অন্যান্য গণসমাবেশ, বিদ্যালয়, খাওয়ার পানি পরীক্ষা করাবেন, ব্যবহারযোগ্য পানি, পুকুর, নলকূপ, পরিচ্ছন্ন, মহামারী রোধে ভূমিকা রাখবেন, রোগতত্ত্ব বিষয়ে তদন্ত ও প্রতিকার, জন্ম-মৃত্যু সনদ তৈরিতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে সহায়তায় ভূমিকা পালন করবেন। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ ও জনসাধারণের খাদ্য নিশ্চিত করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এ দায়িত্ব নিশ্চিত করতে একজন স্যানিটারি পরিদর্শক হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জে খাদ্যের সব দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বেকারি, অন্যান্য খাদ্য উৎপাদনকারী, সংরক্ষণকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করবেন। নিয়মিত এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে বিশুদ্ধ খাদ্য আইন, ১৯৬৭ অনুযায়ী খাদ্যের স্ট্যান্ডার্ড যাচাই ও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। খাবার অযোগ্য হলে তা ধ্বংস, সন্দেহজনক হলে জব্দ, পরীক্ষণের নমুনা সংগ্রহ এবং অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশের কারণে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের মামলা করারও বিধান রয়েছে।
জনসংখ্যার আনুপাতিক হার বিবেচনা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি পদ সৃষ্টির সুপারিশ এবং স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতামত ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সুপারিশের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৪৮৩টি উপজেলায় ৪৬৫টি পদের অতিরিক্ত ৫০১টি স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, স্যানিটারি পরিদর্শকের নতুন পদের বিষয়টি কেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নাকচ করেছে, তা ফাইল না দেখে বলা যাবে না। তবে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে যেখানে যে ধরনের কর্মসূচি প্রয়োজন, সরকার তা করবে।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, দেশের প্রতিটি উপজেলায় একজন স্যানিটারি পরিদর্শক দায়িত্বরত থাকলেও তারা জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। দায়িত্বের তাগিদ থেকে রুটিনকাজের বাইরে কিছু করা দূরে থাক, অধিকাংশ কর্মকর্তাই হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যহানিকর খাবারের উৎস পরিদর্শন না করেই ওপর মহলে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছেন। অনেকে আবার এজন্য মাসোয়ারা নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্যানিটারি পরিদর্শকের নতুন ৯৬৬টি পদ সৃষ্টির জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে একটি প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আসে। এরপর মন্ত্রণালয় থেকে সেটি যাচাই-বাছাই করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পদের সংখ্যা কমিয়ে ৫০১ করার প্রস্তাব করে ফাইলটি ফেরত পাঠায়। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে আবার নতুন প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাতে অসম্মতি জানায়। এতে জনগুরুত্বপূর্ণ এ পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন স্বাস্থ্য সহকারী পদ থেকে চার বছরের কোর্সের মাধ্যমে স্যানিটারি পরিদর্শক নেয়া হয়। বর্তমানে ৮৫০ জন প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন এবং আরো ৬০০ জন প্রশিক্ষণরত। এদের পদায়ন করলে সরকারের খরচও অনেকটা কমে যাবে।
জনস্বাস্থ্যের দায়দায়িত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ-ভারতের তিনটি প্রদেশে (মুম্বাই, মাদ্রাজ ও বেঙ্গল) ১৮৬৪ সালে মহুকুমাভিত্তিক স্যানিটারি কমিশনারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২৭ সালে দেশবন্ধু চিত্ররঞ্জন দাশের নেতৃত্বাধীন সরকার প্রশাসনিক কাঠামো অনুযায়ী সমগ্র বেঙ্গল প্রদেশের থানাগুলোয় একজন করে স্যানিটারি পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৯-১০ গুণ বেড়েছে; বেড়েছে তাদের জীবনযাপনের জটিলতা ও ঝুঁকি। কিন্তু বাড়েনি স্যানিটারি পরিদর্শকের পদ।