বাংলাদেশের মিডিয়া সেন্সর করছে সরকার
রিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ বাংলাদেশে পরোক্ষ হুমকি ও হয়রানির মাধ্যমে মিডিয়াকে সেন্সর করছে সরকার। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। তাদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণে মাঝে মাঝেই ব্যর্থ হচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি রয়েছে মারাত্মক সমস্যা হিসেবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশে। রাজনেতিক সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশ অংশে এ সব কথা বলা হয়। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় স্টেট ডিপার্টমেন্টে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন।
২০১৩ সালের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ওই রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, খেয়ালখুশি মতো গ্রেফতার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্বল বিচার ব্যবস্থা, বিচারের আগে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা সহ বিভিন্ন বিষয়ের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ৪২ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে বলা হয়, বাংলাদেশে মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খেয়ালখুশি মতো গ্রেফতার, অনলাইনে মতামত প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের দুর্বল অবস্থা ও শ্রম অধিকার। সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি ও এ বিষয়ে সাধারণ ক্ষমা বিষয়টি রয়ে গেছে একটি সমস্যা হিসেবে। ব্যক্তিবিশেষ, বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটছে। শুধু তা-ই নয় নাগরিকদের অধিকার প্রতিহত করা হয়। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা সামপ্রতিক বছরগুলোতে যেসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তার সমন্বিত তদন্ত ও বিচারের পদক্ষেপ নেয় নি সরকার। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে কি পরিমাণ মানুষ নিহত হয়েছেন তার কোন পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা শূন্য সহনশীলতা ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে প্রতিশ্রতি দিলেও তা রয়ে গেছে। ২০১৩ সালের প্রথম ৯ মাসে র্যাবসহ নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৪৬ জন। ঘেরাও, গ্রেফতার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অপারেশন চালানোর সময়ও মারা গেছে মানুষ। সরকার যথারীতি এগুলোকে ‘ক্রস ফায়ার’ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ‘এনকাউন্টার কিলিং’ বলে বর্ণনা করেছে। এক্ষেত্রে ২০১২ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ৭০।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৯২টি অপরাধ বিষয়ক অভিযোগ আনা হয়। তাকে আটক রাখা হয় ৯১ দিন। ৪ নভেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম. কে আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মওদুদ আহমেদ, আবদুল আওয়াল মিন্টু ও শিমুল বিশ্বাসকে গ্রেফতার করে। অভিযোগে বলা হয়, তারা রাজনৈতিক বিক্ষেভে সহিংসতা উস্কে দেয়ার জন্য দায়ী।
ওই রিপোর্টে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলা হয়, মুক্ত মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখাতে মাঝে মাঝেই ব্যর্থ হয়েছে সরকার। মুক্ত মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হয়রানি ও প্রতিশোধ নেয়ার আতঙ্কে কিছু সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে সেলফ সেন্সরশিপ করে। সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করেছে পুলিশ।
অধিকার-এর মতে, কোন সাংবাদিক ২০১৩ সালে নিহত না হলেও জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ১৪৪ সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে না হয় তাদের হুমকি দেয়া হয়েছে। আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন দু’সাংবাদিক। ৩৯ জনের ওপর হামলা করা হয়েছে। রাজনৈতিক দল, সরকারি কর্মকর্তারা হামলা অথবা হুমকি দিয়েছেন ২৩৪ জনকে। ১৪ জানুয়ারি অস্ত্রধারীরা চুরিকাঘাত করে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে। ৫ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রধারীরা হামলা চালিয়ে হত্যা করে ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দারকে। ২০ জুলাই আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি গোলাম মওলা রনি দু’সাংবাদিক ইমতিয়াজ মোমিন ও মোহসিন মুকুলকে অপদস্ত করেন। এ দৃশ্য ধরা পড়ে মুকুলের ক্যামেরায়। পরে তা ব্যাপক প্রচার পায়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুন করা হয় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে। এ ঘটনায় ২০১৩ সালেও কাউকে গ্রেফতার করা হয় নি। ১৪ ফেব্রুয়ারি সরকার বিরোধী দল সমর্থিত দৈনিক আমার দেশ, দিনকাল, সংগ্রাম, দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশনকে আওয়ামী লীগ সম্পর্কিত ইভেন্ট কভার করার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করে। ৬ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামীর সমাবেশ সরাসরি সমপ্রচার করায় দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন ও রেডিও কমিশন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আগে থেকে এ মর্মে নোটিশ পাওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
৬ মে ও ১৪ মে বিএনপিকে সমাবেশ করতে অনুমতি দেয়নি সরকার। ১৯ অক্টোবর পুলিশ ঢাকায় সকল সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু ২৫ অক্টোবর বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। এ আইনে কোথাও চার জনের বেশি মানুষের সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে কর্তৃপক্ষ এ বিধান ব্যবহার করে ১০৫ বার। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সভা সমাবেশ ভণ্ডুলে অংশ নেয়। ৫ ও ৬ মে সরকার হেফাজতে ইসলামের ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি পণ্ড করে দিতে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের মোতায়েন করে। প্রথম দিকে সরকার তাদেরকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু তাদের র্যালি সহিংস হয়ে উঠার পর সরকারি কর্মকর্তারা তাদেরকে মতিঝিল থেকে সরে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় তারা ওই স্থান ত্যাগ করেনি। সরকার দাবি করে, পুলিশ ও ইসলামী দলটির মধ্যে সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দৃশ্য দেখিয়ে বলা হয়, হতাহতের সংখ্যা ১০ থেকে ১৬। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও আল জারিরা রিপোর্টে বলে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন। জুনে অধিকার তার রিপোর্টে বলে, দু’দিনের ওই সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬১ জন।
ওই রিপোর্টে সরকারের দুর্নীতি ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে বলা হয়। এতে বলা হয়, আইন অনুযায়ী দুর্নীতির দায়ে সরকারি কর্মকর্তারাও শাস্তির যোগ্য। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে কার্যকরভাবে আইন প্রয়োগ করে নি। ২০১৩ সালের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেছে মানবাধিকার গ্রুপগুলো, মিডিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য কিছু সংস্থা। যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত হয়েছেন তারা দায়মুক্তির সুযোগ পেয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার সরকারি প্রতিষ্ঠান হলো দুদক। ২০১০ সালের বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সরকার দুদকের কাজকে খর্ব করে দেখে এবং তারা দুর্নীতির বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে। দুদকের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে এ প্রতিষ্ঠানকে ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করেছে।
এছাড়া ওই রিপোর্টে এনজিও সংস্থা, বিশেষ করে অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে হয়রানির প্রসঙ্গ উঠে আসে। উঠে আসে আদিবাসীদের অধিকার, নারী অধিকার, ধর্মীয় অধিকারসহ নানা প্রসঙ্গ। বলা হয়, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭২৯টি।
এতে উঠে আসে শ্রমিক অধিকার প্রসঙ্গও। বলা হয়, শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়া হলেও নিবন্ধনের ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। এতে সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহত হন কমপক্ষে ১১৩৩ জন শ্রমিক। আহত হন ২৫০০ শ্রমিক।